বৈদ্যুতিক বাতি
শত শত বিজ্ঞানীর শত শত বছরের সাধনার ফলে একদিন বিদ্যুৎ হয় করায়ত্ত। চমকিত হয়েছিল মানুষ বিদ্যুতের প্রচন্ড শক্তির পরিচয় লাভ করে। অতঃপর ডায়নামাে আবিষ্কৃত হলে বিজ্ঞানীদের মাথায় আসে নতুন চিন্তা। ভাবলেন, যেমন করেই হােক বিদ্যুৎকে নিয়ে আলো জ্বালাতে হবে। কাজে নেমে দেখলেন,যখন কোন তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তখন তারটি উগপ্ত হয়ে উঠে। অবশ্য এর আগে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশের বিদ্যুৎকে মাটিতে নামিয়ে এনে প্রমাণ করেছিলেন, আকাশের বিদ্যুতের সঙ্গে মানুষের তৈরি বিদ্যুতের কোন ভেদ নাই।
বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন, আকাশে বিদ্যুৎ স্কুরণের সঙ্গে সঙ্গে আলাে জ্বলে। ওঠে, অপরদিকে বিদ্যুৎ স্পর্শে ধাতব তার গরম হয়ে উঠে। তবে কেন আলাে জ্বালানাে যাবে না? অনেক ভেবে-চিন্তে প্রথম তৈরি করা হল আর্ক ল্যাম্পকে। শহরের রাস্তায় বসানাে হল এই ল্যাম্পকে এবং তখনই জয় জয়াকার পড়ে গেল। চারদিকে। তখন চলেছে বিজ্ঞানের যাদুকর টমাস আলভা এডিসনের আমল। পরীক্ষায় বসে গেলেন এডিসন। কত হরেক রকমের মােটা ও সরু তার
দিয়ে আরম্ভ হল তাঁর গবেষণা। একদিন তাঁর নজরে পড়ল, যেসব তারের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে, বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে সেগুলাে সবই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। আবার যে তারের রােধ যত বেশী, সেই তারের কুন্ডলীর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চালালে তত বেশী উত্তপ্ত হয়। পরীক্ষার দ্বারা আরও বুঝতে পারলেন, পরিবাহী তার সরু হলেই রােধ বেশী হয়।
চলল গবেষণার পর গবেষণা। সরু তার বা ফিলামেন্ট তৈরি করতে গিয়ে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হল তাঁকে। দেখলেন, সব পরিবাহীর সরু তার এ কাজের উপযােগী নয়। বেশীর ভাগ সরু তারই বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠানাের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
যতই বাধা পেতে লাগলেন, ততই তাঁর উৎসাহ বেড়ে চলল। শেষে বহু পরীক্ষ-নিরীক্ষার পর আবিষ্কার করলেন কার্বন দিয়ে ফিলামেন্ট প্রস্তুত করলে সহ পুড়ে ছাই হয়ে যায় না। একবার নয়, দুবার নয়, বেশ কয়েকবার ধরেই পরীক্ষাটা করলেন। কোন বারেই কার্বন ফিলামেন্ট পুড়ে গেল না। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এডিসনের মখ। বুঝি বা এতদিনে তাঁর স্বপ্ন সার্থক হল।
ইংরাজী ১৮৭৯ সাল। এডিসন একটা কাচের বাঘে কার্বন ফিলামেন্ট সংযােগ করে বাষটিকে বায়ুশূণ্য করলেন। তারপর তার ভেতর দিয়ে পাঠালেন বিদ্যুৎ। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন-ফলটা কী দাঁড়ায় দেখার জন্য। বেশ কয়েক ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এডিসন দেখলেন, ফিলামেন্টটা পুড়ে গেল না, অধিকন্তু বেশ কিছুটা আলােও পাওয়া গেল।
সে আলােটা আজকের দিনে বৈদ্যুতিক বাতি থেকে যে পরিমাণ আলাে পাওয়া যায়, তার চেয়ে অনেক কম ছিল। তবুও বেজায় খুশি হলেন এডিসন। শােনা যায়, দুদিন এবং দুরাত ধরে ফিলামেন্টের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ অব্যাহত রেখেছিলেন, তবুও ফিলামেন্টটি পুড়ে যায়নি।
পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে একটি প্রদর্শনীতে এডিসন সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করেন তাঁর এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারটি। কিন্তু সেই প্রদর্শনীতে আরও একজন বিজ্ঞানী উক্ত পরীক্ষাটি তুলে ধরলেন। তাঁর বাতিটিও ছিল কার্বন ফিলামেন্ট দিয়ে তৈরি। সেই বিজ্ঞানীর নাম জোসেফ উইলসন স্বায়ান।
দুজনেরই এক আবিষ্কার। দর্শকদের মধ্যে বাকবিতন্ডা সুরু হল। প্রথম কে আবিষ্কার করেছেন? একদল বলল এডিসন, কিন্তু দােয়ানের সমর্থক দল সেকথা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। তারা স্বােয়ানকেই প্রথম আবিষ্কর্তার সম্মানে ভূষিত করতে চায়।
শেষে দুই সমর্থক দলের মধ্যে তর্কাতর্কি এমনকি হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। কেউ কেউ এই নিয়ে মামলা দায়ের করতে ছুটল। এডিসন দেখলেন, ব্যাপারটা ভয়ানক বিশ্রী অবস্থায় এসে যাচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ছুটলেন জোসেফ দােয়ানের কাছে। ইচ্ছা, এই নিয়ে একটা আপােষ করবেন তিনি।
জোসেফও ব্যাপারটা আদৌ পছন্দ করেননি। এডিসন আসতেই মিমাংসা করতে সম্মত হয়ে গেলেন। প্রস্তাবটা এডিসনই করলেন। বললেন, “আমরা দুজনে যখন একই সময়ে এবং একই জিনিস আবিষ্কার করেছি, তখন বাতিটির নাম আমাদের উভয়ের নামেই নামকরণ করা হােক।”
আপত্তি করলেন না জোসেফ উইলসন স্বোয়ান । উভয় আবিষ্কারকের নামানুসারে বাতিটির নাম হল "এডি স্বােয়ান ল্যাম্প"। বৈদ্যুতিক বাতি প্রস্তুতির আপি পর্ব এইভাবে সমাপ্ত হয়েছিল, যদিও পরবর্তীকালে বিভিন্ন আবিষ্কারকের হাতে পড়ে বাতির চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।



