সেলুলয়েড (Celluloid) কি কেনো কিভাবে আবিষ্কার হলো।

 সেলুলয়েড


আজ থেকে মাত্র একশ বছর আগেও খেলনা এবং সৌখিন জিনিসপত্র প্রস্তুতিতে হাতির দাঁতের চাহিদা ছিল যথেষ্ট। ভারি সুন্দর, শক্ত, মজবুত ঐ হাতির দাঁত। এখনও তার কৌলিন্য হ্রাস পায়নি এতটুকু। দামও অনেক। অর্থশালী ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে হাতির দাঁতের জিনিস ব্যবহার এক রকম অসম্ভব। পাশ্চাত্যের বেশীর ভাগ ধনী এবং সৌখিন ব্যক্তিরা এককালে হাতির দাঁতের জিনিসের প্রতি একটা বড় রকমের আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। তাই সেকালে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের চাহিদা মেটাতে একেবারে হিমসিম খেয়ে যেত। এত হাতির দাঁত রােথেকে জোগাড় করবে তারা?


ইংরেজী ১৮৬৫ সাল। নিউ ইয়র্কের এক বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান হাতির দাঁতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ল। ঘােষণা করল, যদি কোন ব্যক্তি হাতির দাঁতের বিকল্প কোন কৃত্রিম জিনিস প্রস্তুত করতে পারে, তাহলে তাকে নগদ দশ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।



দশ হাজার ডলার! অর্থের পরিমাণটা বেশ লোভনীয়। ঘােষণার কথা শুনে বহু বিজ্ঞানী এগিয়ে এলেন। কত রকমের কত পরীক্ষা চলতে লাগল। কত বিজ্ঞানী আহার নিদ্রা ছেড়ে দিয়ে গবেষণাগারে পড়ে রইলেন। কিন্তু আশার আলাে কেউ দেখতে পেলেন না। শেষে খবরটা এসে পৌছােল গবেষণা পাগল দু ভাই--ওয়েলসিহায়াট এবং ইসাইয়া হায়াটের কানে। ভাবলেন, একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না কেন। যদি এতগুলাে অর্থ হাতে এসে যায়! যেই ভাবা সেই কাজ। শুভক্ষণে দু’নেই আরম্ভ করলেন গবেষণা। কী খেয়াল হল তাদের! প্রথমেই আরম্ভ করলেন নাইট্টো সেলুলােজকে নিয়ে পরীক্ষা। কারণ একটা অবশ্য ছিল। হায়াট ভ্রাতৃদ্বয় সদ্য আবিষ্কৃত নাইট্টো সেলুলােজের প্রতি একটা বড় রকমের আকর্ষণ বােধ করতেন।


নাইট্রো-সেলুলােজ আবিষ্কারের পেছনে একটু ইতিহাস আছে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তার কিছু পূর্বে সেলুলােজকে নিয়ে গবেষণার ধুম পড়ে গিয়েছিল। সেলুলােজ হচ্ছে-উদ্ভিদের দেহকোষের একটা বিশেষ উপাদান। তুলাে,পাট প্রভৃতির আঁশে সেলুলােজ যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়!


সে সময় বার্মিংহােম বাস করতেন এক রসায়ন বিজ্ঞানী। নাম তাঁর আলেকজান্ডার পার্কস। খেয়ালী তিনিও বড় একটা কম ছিলেন না। একদিন কী মনে হল তাঁর ! সেলুলােজের সঙ্গে নাইট্রিক আসিডকে মিশিয়ে ফেললেন। আর যায় কোথায় ! আপন খেয়ালের ফসর হিসিবে পার্কস সেদিন উপহার দিলেন একটি বিস্ফোরক পদার্থকে। নামকরণ তিনিই করলেন। যেহেতু নাইট্রিক অ্যাসিড ও সেলুলােজের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়েছিল, তাই নাম হল নাইট্রো সেলুলাজ।


পার্কস বিস্ময়ের সঙ্গে আরও লক্ষ্য করেছিলেন, সেলুলােজের সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিড বেশী পরিমাণ মেশালে উৎপন্ন হয় দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থ, কিন্তু অ্যাসিডের পরিমাণ কম হলে উৎপন্ন পদার্থটি দাহ্য ও হয় না এবং বিস্ফোরকও নয়। উভয় বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থগুলােকে যদিও নাইট্রো সেলুলােজ বলা হলাে তবু বিস্ফোরক নাইট্রো সেলুলােজের নাম দেওয়া হলাে “গানকটন”।


পার্কসের এই আবিষ্কারের পর দেশে দেশে যথেষ্ট সাড়া পড়ে গিয়েছিল এবং বহু রসানয় বিজ্ঞানী পার্কসের এই আবিষ্কারকে নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। হায়াট ভ্রাতৃদ্বয়ও ছিলেন এই দলের। তাঁদের খাস কাজ ছিল সেলুলােজের সঙ্গে এটা ওটা মিশিয়ে দেখা নাইট্রো সেলুলােজকে নিয়ে গবেষণা করতেন তাঁরা। পুরস্কারের কথা শােনার পর ভাবলেন তাঁরা, সেলুলোজ থেকে যদি বিস্ফোরক পদার্থ তৈরি হতে পারে তাহলে শক্ত ও মজবুত জিনিস কী তৈরি করা যাবে না?


একদিন কী মনে হল তাঁদের। পার্কসের ঐ নাইট্রো সেলুলােজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেন একটুখানি কপূর। ফলটা কী দাঁড়ায় দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়ল, নাইট্রো সেলুলােজ রূপান্তরিত হয়ে গেল অর্ধ তরল এক ধরনের বিশেষ পদার্থ। একেবারে স্বচ্ছ সেই পদার্থ। মালিন্য নেই কোথাও এতটুকু। এবার ওকে কঠিনে রূপ দেওয়ার পালা। কিন্তু খুব বেশী বেগ পেতে হল না। অল্লায়াসেই তরলটাকে কঠিন করে নেওয়া গেল।


বেজায় খুশী হলেন হায়াট ভ্রাতৃদ্বয়। নিজ হাতে তৈরি করলেন একটা ছাঁচ। ঢালাই করার পর দেখলেন ভারি সুন্দর হয়েছে জিনিসটা। হাতির দাঁতের মত না হলেও বেশ শক্ত এবং মজবুত। বুঝতে পারলেন, ছাঁচে ঢালাই করলে সব রকমের জিনিসই তৈরি করা যেতে পারবে।


নাইট্রো সেলুলােজের সঙ্গে কর্পূর মেশানাের ফলে যে অর্ধ তরলটি পাওয়া গেল তাতে রঙ মিশিয়েও আনন্দিত হলেন। লাল, নীল, সবুজ, হলদে প্রভৃতিও যে কোন রঙের জিনিস তৈরি করতে কোন বাধা নেই। হায়াট ভ্রাতৃদ্বয়ের এই আবিষ্কার লুফে নিল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি। পুরস্কার তাে লাভ করলেনই, অধিকন্তু তাঁদেরই প্রচেষ্টায় শিল্পজগতে এল দারুণ এক সাড়া। মুল পদার্থ সেলুলােজ থেকে উৎপন্ন হল বলে এই বিশেষ পদার্থটির নাম হল সেলুলয়েড।

Post a Comment

Previous Post Next Post