ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ও সূচ(Injection syringes and needles)কি কোনো কিভাবে আবিষ্কার।

 ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ও সূচ


ইনজেকশন দেওয়ার প্রথম প্রচলন শুরু করেন এক দরদী চিকিৎসক এবং ইনজেকশন দেওয়ার সরঞ্জামও তাঁরই বিষ্কার। যদিও তাঁর উদ্ভাবিত ইনজেকশন প্রণালী ও সাজ-সরঞ্জাম আজকের মত এত সুন্দর ছিল না। ভোতা ভোঁতা লােহার সূচ ছিল এবং সিরিগ্টাও ছিল লােহার । যেমন অমসৃন তেমনই বিদঘুটে। সে যত্নে ইনজেকশন গ্রহণ করতে রােগীদের দস্তুরমত কষ্ট হতাে। তবে এও মনে রাখতে হবে যে, আবিষ্কারের প্রথম লগ্নে কোন কিছুই তার নিজস্ব উন্নত রূপটা পায় না। দিনের পর দিন বহুজনের চিন্তাভাবনায়, চেষ্টা ও অধ্যবসায়ে উন্নত রূপটা পায় না। দিনের পর দিন বহুজনের চিন্তাভাবনায়, চেষ্টাও অধ্যবসায়ে উন্নত রূপ গ্রহণ করে থাকে। তবু সেই ভোঁতা যন্ত্র যিনি বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ভাবন করে থাকেন, তিনিই প্রকৃত আবিষ্কারক। তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন সরঞ্জাম আমদানি করবার জন্য ডাক্তারটি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।



এই ডাক্তারটির নাম চার্লস গাব্রিয়েল। তাঁর ইনজেকশন দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কারের মূলে ছােট্ট একটা কাহিনী আছে। সে সময়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে দিগ বিজয়ী বীর নেপােলিয়ান বােনাপার্ট। নেপােলিয়নের যুদ্ধের নেশা যেমন প্রবল ছিল, তেমনই তাঁর একটা মহৎ গুণও ছিল। গুণীজনকে বিশেষ সমাদর করতেন এবং রাজ্যের মহান ব্যক্তিদের সব সময় সম্মান করতেন। এক সময় এই তরুণ প্রতিভাধরকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাঁকে নিয়ােগ করেন সেনাবাহিনীর এক অফিসাররুপে। এই তরুণটিই চার্লস গাব্রিয়েল।


একদিন নেপােলিয়নের পতন ঘটলাে, যুদ্ধেও বন্ধ হলাে। গাব্রিয়েল ঘরে ফিরলেন কিন্তু ভুলতে পারলেন না যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহ দৃশ্যের কথা। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, ক্ষমতার দম্ভ চিরকাল অব্যাহত থাকবে এবং অব্যাহত থাকবে যুদ্ধ জিনিসটা। তাই হতভাগ্য সৈনিকদের জন্য কিছু করা যায় কিনা-এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য তিনি ডাক্তারী পড়তে শুরু করলেন।


চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন শেষে গাব্রিয়েল এবার মন দিলেন গবেষণায়। গবেষণার বিষয় ছিল ক্ষতস্থান থেকে নির্গত রক্তকে বন্ধ করা-যা তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নী্ঘকাল অকন্ত পরিশ্রমের পর প্রয়েল অধিকার বলেন ওষুধ। তার ধন্য হলো, এই ওষুধকে শিরার মধ্যে চুকিয়ে দিতে পারলে ক্ত্থানের রক্ত সহজে জমাট বেঁধে যাবে এবং অল্প সময়ের ভেতরে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাকে। কিন্তু শিরার ভেতরে কেমন করে গুষুধকে চােকানাে যাবে?


আবার শুরু হলাে চিন্তাভাবনা। শিরা ছিদ্ করে কেমন করে সবার ভেতরে রক্তের সাথে মিশিয়ে দেবেন ওষুধ। শেষে ঠিক করলেন,পিচকারি এবং পিচকারির মাথায় ফাঁপা সূচ লাগিয়ে এই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এবার শুরু করলেন পিচকারি তৈরি করতে। যেমন তেমন পিচকারী হলে


তাে হবে না। আবার সুচটাকেও হতে হবে বিশেষ ধরণের। পিচকারির মাথায়


পরবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও রাখতে হবে। গাব্রিয়েল কী করলেন। বন্দুকের নলকে কেটে একটা পিচকারি খাড়া করলেন। তারপর সাধারণ এক মিস্ত্রীকে নির্দেশ দিয়ে বানিয়ে আনলেন লােহার


নবাবিষ্কৃত ওষুধটি এবার প্রয়ােগের পালা। প্রথম তাে আর মানুষের দেহে প্রয়ােগ করা যায় না। তাই গাব্রিয়েল এক ঘােড়ার উপরই চালালেন পরীক্ষা। যদিও ভোঁতা যন্ত্রে ইনজেকশন দিতে কষ্ট হলাে, তবু ফল ভাল পেলেন। বুঝতে পারলেন ওষুধটি মানুষের দেহে প্রয়ােগ করলে কোন বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হবে না।


দিন যায়। গাব্রিয়েলের চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন অন্যান্য চিকিৎসকরাও এগিয়ে এলেন গাব্রিয়েলের পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে। তাঁরাও সিরিগ্জ বানালেন, সূচ বানালেন। কিন্তু গাব্রিয়েল যে সতর্কতা অবলম্বন করতেন-তা তাঁরা করতেন না। ফলে হিতে বিপরীত হলাে। অনেক ক্ষেত্রে ব্লেগীর প্রাণ নিয়ে শুরু হলাে টানাটানি।



হবে নাইবা কেন,? তাঁরা সূচ ব্যবহার করতেন, তাতে কয়েকদিনের ভেতরেই মরিচার আস্তরণ পড়ে যেতাে। মরিচা ধরতাে লােহার সিরিঞ্জেও। ভালভাবে পরিষ্কার করার কথা কেউ চিন্তা করতেন না। ফলে দোষী সাব্যস্ত হলেন গাব্রিয়েল। চিকিৎসকরা একযােগে প্রতিবাদ জানালেন, গাব্রিয়েলের পদ্ধতি ভুল এবং এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে রােগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। পরিত্যক্ত হলাে গাব্রিয়েলের পদ্ধতি। গাব্রিয়েল ও একদিন ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। কিন্তু অজস্র দুর্নাম মাথায় করে বেঁচে রইলাে তাঁর ইনজেকশনের সরজ্ঞাম।


একদিন বিশ্ববিজ্ঞানের রঙ্গমঞ্চে দ্বাদশ সূর্যের দীপ্তি নিয়ে আবির্ভূত হলেন লুই পাস্তুর, পরিণত বয়সে আবিষ্কার করলেন জলাতঙ্ক রােগের সিরাম । কিন্তু এই সিরামকে রােগীর দেহে কেমন করে প্রবেশ করাবেন? সহসা তাঁর চোখের সামনে। ভেসে উঠলো গাব্রিয়েলের সেই অবহেলিত পদ্ধতিটা। পাস্তুর শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে নিলেন সেই সরঞ্জামটা এবং নিজের মত করে নিখুঁত। করে নিলেন। তারপর নিজেই শুরু করলেন ইনজেকশন দিতে।


এবার আর কেউ প্রতিবাদ করলেন না। সবাই স্বীকার করলেন, ক্ষ্যাপা কুকুর কামড়ালে সিরাম ইনজেকশন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। এতদিনে ব্যবসায়ীরা লাভের গন্ধ পেলেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা এগিয়ে এলেন পিচকারি এবং সূচ তৈরি করতে। তাঁদের হাতে পড়ে পিচকারী ও সূচ


উভয়েরই রূপান্তর ঘটলাে। তৈরি হলো ঝকঝকে মসৃণ ও সরু সূচ।


ডাক্তারদের ভেতরে যতই ইনজেকশন দেওয়ার সরঞ্জাম জনপ্রিয় হয়ে উঠলাে, ততই ব্যবসায়ী মহলে প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে গেল যেন। জার্মানীর একটি বাণিজ্য সংস্থা টেক্কা দিল সবার উপরে। তারা কাঁচের পিচকারি বা সিরিঞ্জ তৈরি করে ফেললাে এবং তৈরি করলাে অতি উন্নত মানের সূচ। বর্তমানে এই ব্যবস্থার আরও কত উন্নতি ঘটেছে। অথচ এর মূলে রয়েছে সেই মানবদরদী বিজ্ঞানী গাব্রিয়েলের অবদান। ইনজেকশন গ্রহণের সময় আমরা ক'জন বা তাঁকে স্মরণ করি?

Post a Comment

Previous Post Next Post