বারুদ
বন্দুকের টোটা, হাত বােমা, আতসবাজি প্রভৃতির মূল উপাদান বারুদ। কিন্তু এই বারুদ যে কবে এবং কীভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল, সে কথা বলা বড়
শক্ত। শােনা যায়,প্রথম বারুদ নাকি চীনারা তৈরি করেছিলেন। অনেকে মনে করেন বাইজেন্টাইনরাই প্রথম প্রকৃত বারুদ প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জ্ঞানী-গুণীদের মতে ১৩২৮ খ্রীষ্টাব্দে বারখােন্ড সােয়াজই প্রথম বারুদ আবিষ্কার
করেন এবং তাঁরই সময় থেকে বারুদের ব্যবহার প্রচলিত হয়
বারুদ বিস্ফোরক পদার্থ। এর উপাদানগুলির মধ্যে আছে সােরা, গন্ধক এবং কাঠ কয়লা। বারখােন্ড সােয়ার্জের আবিষ্কারের প্রায় বিশ বছর পরে কামান বন্দুকের গুলি ছোড়ার কাজে ব্যবহার করা হয় বারুদকে। সেই থেকে যুদ্ধের কাজে বারুদ হয়ে উঠে অপরিহার্য এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তরবারি, বর্শা, কুঠার প্রভৃতি অস্ত্রগুলির বিদায় আসন্ন হয়ে উঠে।
প্রাথমিক অবস্থায় বারুদ ব্যবহারে ভয়ানক অসুবিধা ছিল। সে সময় যে বারুদ তৈরি হত, তা গুড়া ছিল না। শক্ত শক্ত ডেলার আকারে থাকত। তাই সেই বারুদকে ভালভাবে চেপে বন্দুক কামানের মুখে পােরা যেত না। আবার সে সময় বন্দুক ও কামানের উন্নতিও হয়নি বা আজকের দিনের মত টোটাও তৈরি হয়নি। বন্দুকধারীকে একবার গুলি ছোড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে নলের মধ্যে বারুদ পুরতে হত। কামানের নল বেশ মােটা থাকার জন্য সুবিধে হতে বেশী কিন্তু বারুদ খরচ হত বস্তার পর বস্তা। অনেক পরে গুড়া করার যন্ত্র আবিস্কৃত হওয়ায় বারুদ ব্যবহারের সুবিধে হয় এবং বন্দুক কামানেরও উন্নতি হয়।
প্রথমে বলা হয়েছে, বারুদ একটি বিস্ফোরক পদার্থ। বিস্ফোরণ ঘটার একমাত্র কারণ হচ্ছে দ্রুত জারণ ক্রিয়া। জারণ ক্রিয়ার অর্থ যদিও ব্যাপক তবুও মােটামুটি যা বােঝায়, তা হল অক্সিজেনের সংযােগ ঘটা।অক্সিজেন অত্যন্ত সক্রিয় মৌলিক পদার্থ। কতকগুলাে নিষ্ক্রিয় গ্যাস ছাড়া আর প্রায় সব মৌলিক পদার্থের সঙ্গে সে ক্রিয়া করতে পারে। তবে এই ক্রিয়া কারও সঙ্গে হয় অতি দ্রুত আর কারও সঙ্গে অতি মন্থর। আবার এমন কতকগুলাে পদার্থ আছে, যাদের সঙ্গে অক্সিজেন চোখের পলক ফেলতে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। তেমনভাবে যুক্ত হলেই বিক্ষোণের সৃষ্টি হয়।
ধরাযাক, একগাদা কয়লার ডেলা খােলা জায়গায় পড়ে আছে। কয়লা অক্সিজেনের সঙ্গে ক্রিয়া করে এবং আশেপাশে বাতাসেও আছে অক্সিজেন। কিন্তু অক্সিজেন কয়লার সঙ্গে ভালভাবে ক্রিয়া করতে পারছে না বলে আমাদের চোখে কল পৰন হরা পছে না। এবার কয়লার ডেলাকে একটু ভেঙ্গে আ করলে আক্িকেনের সংযোগ দ্রুত হবে এবং আমরা তাপ ও আলাে উভয়ই লাভ কষধ। পরিশেষে সেই কয়লাকে অতি অহি গুঁড়ায় পরিণত করে অকিনে পরিকেশে হাদি উত্তপ্ত করা হয় তাহলে বিস্ফোরণ ঘটবে। এবাৰ থােকা গেল, কয়লার গুড়াকে অক্সিজেনের সংস্পর্শে রাখলে বিস্ফোরণ
ঘটাবে। কিন্তু যেখানে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে গেলে কোথায় পাওয়া যাবে
এমন পরিবেশ?
পণ্ডিতেরা অনুমান করলেন কয়লার সঙ্গে এমন একটা জিনিস মিশিয়ে দিতে হবে, যাকে গরম করলে আপনা হতেই পাওয়া যাবে প্রচুর অক্সিজেন। তেমন জিনিস খুঁজতে গিয়ে তার হাতের কাছে পেলেন সােরাকে। সােরার মধ্যে থাকে পটাসিয়াম, নাইট্রোজেন এবং প্রচুর অক্সিজেন। তাপ পেলে সােরা ভেঙ্গে গিয়ে উৎপন্ন করে পর্যাপ্ত অক্সিজেন-যা কয়লার গুঁড়ার সঙ্গে ক্রিয়া করে পলকের মধ্যে বিক্ষোরণ ঘটায়।
বান্দ প্রকৃতির প্রাথমিক যুগে সােরা এবং কাঠ কয়লার মিশ্রণকেই বলা হত বরল। ঐ বারুদের ব্যবহার এখনও কোন কোন ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। যার নাম কালাে বা ব্ল্যাক পাউডার।
বারুদ কঠিন পদার্থ। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে সেটি উচ্চ চাপের গ্যাসে জপান্তরিত হয়ে যায়। তখন সেই গ্যাস আশেপাশের বাতাসকে জোরে ধাক্কা দেয় এবং বাতাসে কতকগুলাে ঘনীভূত ও তনীভূত স্তরের সৃষ্টি হয়। তারপর সেই শরগুলাে তরঙ্গের আকারে এগিয়ে যায় দূরে। বিস্ফোরণ অতি দ্রুত হলে তরঙ্গের বেগ দ্রুত হয় এবং ধ্বংস করার ক্ষমতা লাভ করে। তরঙ্গের বেগ অপেক্ষাকৃত কম হলে ধ্বংস করার চেয়ে জোরে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতাই লাভ করে বেশী। |
বন্দুক ও কামানে যে বারুদ ব্যবহার করা হয়, তার কার্যপ্রণালী হচ্ছে, জোরে ধাক্কা দিয়ে কতকগুলাে ধাতব টুকরা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাতব বলকে অতি দ্রুত ঠেলে দেওয়া। যাঁরা বন্দুক ছোঁড়েন, তাঁরা এ ব্যাপারটা ভাল করেই বােঝেন। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলাে ছােট ছােট সীসার বল সজোরে বেরিয়ে. দীর্ঘকাল ধরে বারুদ কামান, বন্দুক প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্রে এবং আতসবাজি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। বিংশ শতাীয় প্রথম দিকে “মাটিন ওয়েন্ধে নামে এক বিজ্ঞানী ঘােষণা করলেন, বারুদকে শিল্পক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ভূগর্ভ থেকে ধাতব আকরিককে উত্তালন করার কাজে তিনিই প্রথম বারুদের সাহায্য নেন এবং সাফল্যও অর্জন করেন। রাস্তা তৈরির কাজেও একদিন বারুদের সাহায্য নেওয়া হত। এখন বারুদের চেয়ে ঢের বেশী শক্তিশালী বিস্ফোরক পদার্থ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে বারুদের ব্যবহার সীমিত হয়ে এসেছে।
প্রথম যখন কামান ও বন্দুক তৈরি হয়েছিল, তখন ওদের রেঞ্জ ছিল খুবই কম। তার প্রধান কারণ, ডেলা বারুদ ব্যবহার করা হত সেদিন। আগুন ধরলে বারুদের বহিভাগই কেবল জুলতে থাকত, কিন্তু ভেতরে আগুন প্রবেশ করত পরে। ফলে অযথা বহু গ্যাস নষ্ট হয়ে যেত। এই অসুবিধা দূর করেন উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্যাপ্টেন টমাস রডম্যান নামে জনৈক সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ। তিনি বারুদের ডেলার মধ্যে ছিদ্র করে দিয়ে ব্যবহারের প্রচলন করেন।


