সাইক্লোট্রোন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। পৃথিবীর মানুষ সবেমাত্র বুঝতে আরও করেছে পরমাণুর প্রকৃত স্বরূপ। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, পরমাণু হচ্ছে পদার্থের মৌলিক কণিকা । তাকে ভাঙ্গা যায় না, আবার গড়াও যায় না। মনে করা হতাে,পদার্থের অন্তিম ও অবিভাজ্য কণা এই পরমাণু।
ইংরাজী ১৮৯৬ সালে বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী হেনরী বেকারেল দেখতে পেলেন, ইউরেনিয়াম ঘটিত লবণ থেকে এক ধরণের অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয় এবং এ রশ্মি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে আক্রমণ করে। এই রশ্মির বৈশিষ্ট্য যে, উত্ত্ত অথবা শীতল অবস্থায়, বায়ুশূন্য পরিবেশে অথবা অধিক বায়ুর চাপে, আলোকে অথবা অন্ধকারে, সর্বাবস্থায় একই হারে নির্গত হয়। আবিষ্কারকের নাম অনুসারে এই রশ্মির নামকরণ করা হয় বেকারেল রশ্মি।
একদিন ইউরেনিয়ামকে তার লবণ থেকে পৃথক করা হল। ১৮৯৮ এবং ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে কুরি দম্পতি আবিষ্কার করলেন আরও দুটি তেজস্ক্রিয় মৌল- পােলােনিয়াম এবং রেডিয়াম। এই দুটি মৌল আবার ইউরেনিয়াম অপেক্ষ অধিক তেজস্ক্রিয়। বিজ্ঞানীদের এবার ভাববার পালা। কেন এই সব পদার্থ থেকে অবিরাম এবং স্বতস্ফূর্তভাবে অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয় ? এগিয়ে এলেন বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড। তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ থেকে নির্গত রশ্মিকে চৌম্বক বা তড়িৎ ক্ষেত্রের ভেতর অতিক্রম করিয়ে দেখলেন, রশ্মির একাংশ চৌম্বক ক্ষেত্রের একদিকে সামান্য বেঁকে যাচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখলেন, এই রশ্মিগুলি ধনাত্নক তড়িৎ যুক্ত। অপর অংশ ঋণাত্নকতড়িযুক্ত রশ্মি বেঁকে গেল বিপরীত দিকে। অবশিষ্ট নিস্তড়িৎ রশ্মি কোনদিকে না বেঁকে সােজা এগিয়ে গেল। রাদারফোর্ড রশ্মিগুলির নাম দিলেন আলফা রশ্মি, বিটা রশ্মি, এবং গামা রশ্মি।
পরীক্ষার সাহায্যে ধরা পড়ল, ধনাত্মক তড়িযুক্ত আলফা রশ্মি কতকগুলি পদার্থ-কণার সমবায়ে গঠিত। এক একটি আলফা কণার ভর প্রােটনের ভরের চার গুণ কিন্তু তড়িৎ মাত্রা প্লোটেনের দ্বিগুণ। হিলিয়াম পরমাণু থেকে ইলেকট্রন অপসারিত করলে যে হিলিয়াম আয়ন উৎপন্ন হয়, আলফা কণা তা থেকে একেবারে অভিন্ন। আর এই কণার গতিবেগ আলােকের গতিবেগের দশ ভাগের এক ভাগ।
বিটা রশ্মিকে পরীক্ষা করে দেখা গেল, ড়িৎ ঋণাত্মক এই রশ্মি ইলেটনেয় সমণিী মাত্র এবং এই কণিকা ও ইলেকট্রন অভিন্ন। বিটা কণিকার গতিবেগ আলফা কণিকার চেয়ে বেশী । তড়িৎ নিরপেক্ষ গামা কণিকা পরমাণুর অত্যা মটন কণিকা।
এতদিনে পরিবর্তিত হল বিজ্ঞানীদের পরমাণু সম্বন্ধে আগেকার ধারণা। দলে দলে বিজ্ঞানী এগিয়ে এলেন পরমাণুর গঠন ব্যাখা করতে। তাঁদের পরীক্ষা এবং সিদ্ধান্ত থেকে জানা গেল, প্রত্যেকটি পরমাণুর কেন্দ্রে আছে কেন্দ্রক। কেন্দ্রকের মধ্যে প্রােটন, নিউটন এবং আরও কতকগুলি কণিকা পিউবদ্ধ অবস্থায় আছে এবং কেকের চারপাশে আবর্তনরত ইলেকট্রন মহল।
ইংরাজী ১৯১৯ সালে, এক নতুন তথ্য উদঘাটন করলেন পরমাণু বিজ্ঞানের জনক রাদারফোর্ড। প্রমাণ করলেন, ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম প্রভৃতি স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ থেকে নির্গত আলফা কণা দিয়ে কোন স্থায়ী মৌলের কেন্দ্রকে আঘাত করলে কেন্দ্রকে বিক্রিয়া ঘটান যায়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসেছে পরমাণু বিজ্ঞানে বিরাট বিপ্লব। বিজ্ঞানীরা, সেই দিনই বুঝতে পারলেন পামাণুর অপরিমেয় শক্তির কথা। পরমাণুকে নিয়ােগ করা হল ধ্বংসাত্মক ও সৃজনাত্মক উভয় ধরণের কাজে। তাই রাদারফোর্ডের এই আবিষ্কারকে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলা যেতে পারে এবং এই আবিষ্কারটি হচ্ছে সাইক্লোট্রোন যন্ত্র উদ্ভবের মূল কারণ।
স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থগুলি সবই অস্থায়ী। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে করতে একদিন তারা সাধারণ সীসার মত স্থায়ী মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়। তার উপর তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থগুলাে প্রকৃতিতে যে পরিমাণে পাওয়া যায়, তা নিতান্তই কম। এই সব কারণে বিজ্ঞানীরা রাদারফোর্ডের পরীক্ষাটিকে ভিত্তি করে কৃত্রিমভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রস্তুত করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পরমাণু বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়, আলফা কণার পরিবর্তে প্রােটনকে দিয়ে পরমাণু কেন্দ্রকে আঘাত করলেও বহু নতুন তথ্য জানা যেতে পারে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে কেবলমাত্র প্রােটন ? যে সমস্ত স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া যায়, তাদের ভেতর থেকে তিন রকমের কণাই নির্গত হয়। কেবলমাত্র প্রােটন নির্গত হয় এমন মৌলিক পদার্থ তাে জানা নেই। সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হলেন, কৃত্রিম কোন একটা উপায়ে প্রােটনকে তুরিত করা যেতে পারে। তখনই কল্পনা করা হল ত্বরণযন্ত্র বা অ্যাকসিলারেটারের।
বেশীদিন অপেক্ষা করতে হল না। বিজ্ঞানীদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করলেন বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট লরেন্স। ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে কালিফোর্ণিয়ার বার্কলে গবেষণাগার থেকে লরেন্স ঘােষণা করলেন, তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে প্রােটনকে ত্বরিত করা যায়। সেই যন্ত্রটির নাম সাইক্লোট্রোন ।। তুমুল সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে।
আর্নেষ্ট লরেন্সের আগে 'ককক্রফট ও 'ওয়ালটন' নামে দু’জন বিজ্ঞানী "কাসকেড জেনারেটার নামে এক ধরণের যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সে যন্ত্রের সুবিধা ছিল অনেক। তাছাড়া প্রােটনকে দিয়ে পরমাণুর কেন্দ্রকে বিক্রিয়া ঘটানাে তাে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে যে আলফা কণা নির্গত হয়, তার শক্তি অতি সামান্যই। কিন্তু কেন্দ্রকে বিক্রিয়া ঘটাতে হলে শক্তিটা দরকার হয় কয়েক কোটি ভােল্টের মত। আর একটা সমস্যা, এত উচ্চ বিভব ধারণ করার মত অপরিবাহী মাধ্যমই বা কোথায় ? শেষ পর্যন্ত এই সমস্যাগুলি বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব সমস্যাগুলির সমাধান করে আর্নেস্ট লরেন্সই আবিষ্কার করেন সাইক্লোট্রোন যন্ত্র।
আজকাল এই যন্ত্রের উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। এখন কেবলমাত্র প্রােটন কণিকাকে ত্বরান্বিত করা হয় না, অপরাপর কণিকাকেও ত্বরান্বিত করা হয়। কেবল সাইক্লোট্রোন যন্ত্র নয়, এই ধরণের আরও বহু যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত সমস্ত যন্ত্র লরেন্সের তৈরি সাইক্লোট্রোনট যন্ত্রের মত নয়। যন্ত্রটির উন্নতি সাধন হতে হতে এক অতিকায় এবং অতীব ভারী যন্ত্রের রূপ নিয়েছে। ভারী শিল্প ছাড়া এই যন্ত্র আর তৈরি করা সম্ভব নয়। ভারতের পরমাণু গবেষণাগারগুলিতেও এই জাতীয় যন্ত্র আছে।
