গ্যাসমুখােস
আজকের যুদ্ধক্ষেত্রে হামেশাই গ্যাসমুখােস ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া যেসব কারখানায় বিষাক্ত গ্যাস ও ধূলাবালির মধ্যে কাজ করতে হয়- সেইসব কারখানার শ্রমিকরা, খনির শ্রমিকরা, দমকলের কর্মীরা এবং কোন কোন সময় পুলিশও ব্যবহার করেন গ্যাসমুখােস। গ্যাসমুখােস মুখে পরে নিলে বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শে মৃত্যু ঘটতে পারে না। গ্যাসমুখােস আবিষ্কারের পেছনে আছে জার্মানদের অবদান এবং আবিষ্কার করা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের দিকে রসায়ন বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। একদিকে যেমন আবিষ্কৃত হয় নানা মৌলিক ও যৌগিক জনহিতকর পদার্থ, অপরদিকে তেমনই বিজ্ঞানীদের হাতে আসে হরেকরকমের বিষাক্ত পদার্থ।
মানুষ ক্ষমতাকে জাহির করতে এবং অপরের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চিরকাল বিজ্ঞানকে নিয়ােগ করে আসছে। এবার মারাত্নক গ্যাস ইত্যাদির পরিচয় পেয়ে অতি অল্পে শত্রু সৈন্যদের ঘায়েল করতে বিষাক্ত গ্যাসগুলােকেই ব্যবহার শুরু করলাে। গােপনে যুদ্ধক্ষেত্রে নানা ধরণের বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে যেতাে, শত্রু পক্ষের সৈন্যরা সেখানে পা দিলেই গ্যাসের ক্রিয়ায় অন্তেই মারা যেতাে। তাই বিষাক্ত গ্যাস, ধোয়া ইত্যাদি থেকে সৈন্যদের রক্ষা করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই পরিকল্পনা করা হয়েছিল গ্যাস মুখােসের। কথিত আছে, গ্যাস মুখােসের পরিকল্পনা করেছিলেন ফ্রিটজ হাবার-সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সংশ্লেষণী পদ্ধতিতে অ্যামােনিয়া তৈরি করেছিলেন এবং ঐ কারণে জগৎজোড়া সুনামও অর্জন করেছিলেন। ঐ জন্য তিনি ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে লাভ করেছিলেন নােবেল পুরস্কার।
হাবার পরিকল্পনা করেছিলেন কিন্তু পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেননি বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁর এক বন্ধুকে অনুরােধ করেন। বন্ধুটির নাম রিচার্ট উইলস্টেটর। রিচার্ড উইলস্টেটরও ছিলেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী। ইনি সেই উইলস্টেটর, যিনি ক্লোরােফিল সম্বন্ধে মূলবান তথ্য আবিষ্কারের জন্য ১৯১৫ খ্রষ্টাব্দে নােবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি বন্ধুর পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গবেষণা শুরু করেছিলেন। আবিষ্কার করতে উইলস্টেটরের মত এক প্রখ্যাত রসায়নবিদের খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। অচিরেই বানিয়ে ফেললেন মুখ ঢেকে রাখার জন্য এক ধরণের আবরণ, তথা মুখােস।
বিষাক্ত গ্যাস শােষণ করতে যার জুড়ি নেই সেই কাঠ কয়লার গুড়ােকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন অন্যান্য কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থ। গুঁড়ােকে তাে আর নাক মুখে চাপালে হবে না! তাই একটা বিশেষ ধরণের পুরু পদা তৈরি করেছিলেন। সেই পদাটা এমন ছিল যে, পদ্দা ভেদ করে গুঁড়ােগুলাে বার হতে পারতাে না। অথচ বাতাসটিকে ছাঁকনির মত ছেঁকে নিয়ে নাকের সামনে হাজির করা তাে।
যুদ্ধ এমন এক বীভৎস প্রতিযােগিতা- সেখানে এক মারণাস্ত্রকে টেক্কা দিতে আর এক জোরালাে মারণাস্ত্র সব সময় প্রস্তুত হয়েই আছে। এই প্রতিযােগিতার শেষ নেই। সম্ভবতঃ মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিরকালেই অব্যাহত থাকবে এই প্রতিযােগিতা। গ্যাস মুখােসের ক্ষেত্রেও তাই শুরু হয়ে গেল প্রহিযােগিতা। এমন সব বিষাক্ত জিনিস ছড়ানাে হতে লাগলাে- যা কাঠ-কয়লার গুঁড়াের দ্বারা শুদ্ধ হয় না।
তখন অন্য ধরণের গ্যাস মুখােস তৈরির দিকে যত্নবান হতে হলাে। এমনি করে বিষাক্ত গ্যাসের চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের গ্যাস মুখােস আবিষ্কৃত হলাে. একে একে। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বিভিন্ন কারখানা ইত্যাদিতে নিরাপত্তার জন্যও আবিষ্কৃত হয়েছে গ্যাস মুখােস। তাই আজ সর্বক্ষেত্রে গ্যাস মুখােস মানুষের নিরাপত্তার সহায়ক।
বহুল ব্যবহৃত গ্যাসমুখােসগুলাের উপাদান (১) সেলুলােজ কিংবা অ্যাসবেটাস তন্ত্বর পদা। বাতাসে ধুলাবালি এবং প্রলম্বিত কোন বিষাক্ত কণা থাকলে ব্যবহার করা হয় (২) কাঠকয়লা ওড়ানোর তৈরি পর্দা। বায়ুতে অবাঞ্ছিত কোন জৈব গ্যাস উপস্থিত থাকলে ব্যবহার করা হয়ে থাকে (৩) ক্ষার জাতীয় পদ। বাতাসে যদি কোন অ্যাসিড বাষ্প মিশে থাকে তাহলে পর্দার ভেতরে ক্ষারকে রাখা হয় এবং ক্ষারের সংস্পর্শে এসে অ্যাসিড প্রশমিত হয়ে যায়। (৪) বাতাসে কারবন মনঅক্সাইডের উপস্থিতি ধরা পড়লে পদরি মধ্যে ব্যবহার করা হয় ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অক্সাইড ও ফেরিক অক্সাইডের মিশ্রণ (৫) যদি পরিবেশে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাহলে তামার লবণ ভর্তি পর্দা।
এই ধরণের আরও অণেক রাসায়নিক পদার্থকে মুখােসে ব্যবহার হয়। তবে গ্যাস মুখােস দীর্ঘস্থায়ী নয়। কয়েকবার ব্যবহার করার পর রাসায়নিক পদার্থগুলাের পদটি অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে নতুন করে পদাকে যুক্ত করতে হয় মুখােসের ভেতরে। এই মুখােসটা এমনভাবে তৈরি করা হয়- যাতে নাক, চোখ ও মুখ সব সময় মুখােসের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এবং এটিকে বায়ু নিরুদ্ধ করা হয়। বাহিরের বাতাস ছাঁকনির ভেতর দিয়ে ছেঁকেই প্রবেশ করে নাকে। অন্য কোন প্রকার বাতাস প্রবেশ করতে পারে না।