চলমান মহাদেশ
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পৃথিবীর স্থলভাগগুলাে-সেই এক একটি বিস্তীর্ণ ভু ভাগ, যা আমাদের কাছে মহাদেশ নামে পরিচিত- তারাও ঘুরতে আছে। আর মহাসাগরগুলােও প্রসাসিত ও সঙ্কুচিত হতে আছে। হ্যা স্থলভাগগুলাে পথ পরিক্রমা করতে আছে।
তাই বলে আকাশের জ্যোতিষ্কদের মত অক্ষের চারদিকে পাক তে খেতে এত তীব্র গতিতে অগ্রসর হচ্ছে না। পাকও খাচ্ছে না। অগ্রসর হচ্ছে একটু একটু করে। এত সামান্য তাদের গতি যে, সহসা কারও সন্দেহ হয়না, হাজার পুরুষে ধরতেও পারি না আমরা। তবু চলছে, চলছে, আর চলছে। চিরকালই চলছে, চলার তার বিরাম নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গতি বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার।
১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে চলমান মহাদেশের কথা প্রথম জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েগনার দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করলেও আগে এ বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৬২০ খ্রীষ্টাব্দে প্রখ্যাত ইংরাজ দার্শনিক রােজার বেকন পৃথিবীর মানচিত্রে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরের স্থলভাগগুলাের তটরেখা লক্ষ্য করে একটা প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাতে উল্লেখ করেছিলেন সম্ভবত আটলান্টিক সহাসাগরের দুপাশের স্থলভাগ এককালে যুক্ত অবস্থায় ছিল।
১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে জামনি বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফন হামবােল্টও ঠিক একই
মনােভাব পােষণ করেছিলেন। তবে তিনি একটা কারণও উল্লেখ করেছিলেন।
বলেছিলেস, "আটলান্টিকের দুপাশে স্থলভাগ এককালে যুক্ত ছিল। পরে সমুদ্রের
ঢেউয়ের আঘাত খেয়ে খেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে গেছে। হামবােল্টের পরে
আরও বিজ্ঞানী অনুরূপ মনােভাব পােষণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে মার্কিন
বিজ্ঞানী টেলর এবং ফরাসী বিজ্ঞানী স্পাইডার অন্যতম। এঁদের অভিমত ছিল,
সুদূর অতীতে আটলান্টিক মহাদেশ ছিল না। দুপারের দুটি স্থলভাগ অখন্ডই
ছিল। পরে কোন কারণে স্থলভাগটা ভেঙ্গে গিয়ে দূরে সরে গেছে।
উনবিংশ শতাব্দীতে বহুজনে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন সত্য কিন্তু তাঁদের সন্দেহের প্রতি কেউ তেমন গুরুত্ব আরােপ করেননি, বা বিজ্ঞানও স্বীকার করে নেয়নি তাঁদের মতবাদকে। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েগনার স্থলভাগের ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব। উপস্থাপিত করেন এবং তত্ত্বগুলাের মাধ্যমে, আপন বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
চলমান মহাদেশ সম্বন্ধে মতবাদকে সমর্থন করতে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগের নানা নিদর্শনকেও পরীক্ষা করা হয়েছে। সেই নিদর্শনগুলাের মধ্যে জীবাশ্ব অন্যতম। আজকের দিনে যাদের বিচ্ছিন্ন মহাদেশ বলে মনে করা হচ্ছে তাদের জীবাশ্মগুলাের মধ্যে রয়েছে অদুদ মিল। বর্তমান জীব-জগতের বেলায়ও এটি প্রকট। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার জীবজন্তুর মধ্যে বেশ একটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন চলমান মহাদেশের কথা।. অ্যান্টার্কটিকা পৃথক হয়ে সরে গেছে দক্ষিণের দিকে। তারও প্রমাণ সেখানকার প্রাপ্ত জীবাশী। এই দুটি স্থলভাগ পরস্পর বিপরীত দিকে সরে যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে পানির ব্যবধান- ভারত মহাসাগর। এমনটি অন্যান্য স্থলভাগের ক্ষেত্রেও হয়েছে। যাই হােক, বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত তত্ত্ব অনুযায়ী মহাদেশ চলছে, সাগর চলছে, তথা আমাদের পায়ের তলার মাটি স্থির নয়। অনাগত ভবিষ্যতে এর চেহারাটা কেমন হবে, তা কে বলতে পারে।
