মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য

 মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য


পৃথিবীর উপরিভাগে ঐ যে নীল নীল মহাকাশ-ওর প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। মহাবিশ্বের ধারণা আজকের-বিংশ শতাব্দীর। তবে আগেকার জ্যোতির্বিদদের ধারণাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলে নয়। প্রথম কল্পনা ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে তাঁরা কল্পনা করেছিলেন, পারস্য উপসাগরের কালাে পানিই সৃষ্টির উৎস। এর গহবর থেকে প্রথমে উঠে এসেছে পৃথিবী, তারপর পৃথিবীকে বেষ্টন করার জন্য 'খুবুর নামে সামুদ্রিক স্রোত। সবশেষে অগণিত নক্ষত্রখচিত নীল আকাশ। সেখানকার দেবতা সূর্য এবং সূর্যদেবতাই ইচ্ছানুযায়ী নক্ষত্রদের ঘােরাচ্ছেন আকাশ পথে।



মিশরীয়রা মনে করতেন, ঘন তমসাবৃত "নু" নামে আদিম মহাসমুদ্র থেকে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে। বাইবেলে উল্লেখ আছে, ঈশ্বরের আদেশে আদিম মহাসমুদ্রের মাঝখান থেকে উঠে এসেছে নীল আকাশটা এবং ওর বাসিন্দা সূর্য, চন্দ্র ও তারা। বেদে বলা হয়েছে, আদিতে কোথাও কোন কিছু ছিল না। তারপর স্রষ্টার নির্দেশে আদিম মহাঅন্ধকার এবং মহাশূণ্যতার মাঝখানে একদিন নিহিত হয় সৃষ্টির বীজ। কোথায় এবং কেমন করে যে নিহিত হয়েছিল, তা কেউ জানে না। এমন কি দেবতারাও নন। কেন না, দেবতাদেরও আবির্ভাব সৃষ্টির পরে।


যাই হােকনা কেন, আজকের দিনে বিজ্ঞানের অনেক-অনেক উন্নতি হয়েছে। বিজ্ঞানের কৃপায় বহু অজানাকে জানা গেছে, প্রকৃতির বহু রহস্য উদ্ঘাটনও হয়েছে। তবু বলতে হয় বিশ্ব সৃষ্টি সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞানটা প্রাথমিক স্তরের। এ বিষয়ে মানুষের প্রচেষ্টার অবশ্য অন্ত নেই। সহস্র সহস্র বিজ্ঞানী আজ মাথা ঘামাচ্ছেন এ বিষয়ে! বহু হাতিয়ারও তাঁদের হাতে এসেছে। সচবেয়ে বড় হাতিয়ার মহাকাশের নৈপথ্য বিকিরণ। একদিন দূরাগত নক্ষত্র বা নক্ষত্রমন্ডলীর আলােই ছিল তাদের কাছে সব। মহাকাশযানের ও রকেট ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মহাকাশে ধরতে সমর্থ হয়েছেন অতি দূরবর্তী গ্যালাক্সী সমূহ থেকে আগত এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি এবং অণু তরঙ্গদের। সেগুলােকে বিশ্লেষণ করার ফলে বিশ্বসৃষ্টি রহস্যের কুয়াশাটা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে উঠছে।


বিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে কালে কালে বহু তথ্যের আমদানি হলেও প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্বটি প্রদান করেছেন জর্জ গ্যামো, উইৎসেকার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা। তত্ত্বটির নাম 'বিগ ব্যাং থিওরি' বা মহাবিশ্ষোরণবাদ। এই মহবাদটিকে বর্তমানে সবাই মেনে নিয়েছে এবং যাচাই করতে গিয়ে ভাল ফলই পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আদিম বিশ্বব্রহ্মান্ড এত বড় ছিল না। হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, আদিতে বিশ্বটা ছিল প্রজাপতি ব্রহ্মার অন্ড সদৃশ। তাই ব্রহ্ষান্ড নাম। প্রসারিত হতে হতে আজকের এই অকল্পনীয় বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ড। সে প্রসারণ এখনও অব্যাহত আছে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, আদিম নিরাকার বিশ্বে যে কোন কিছুই ছিল না, এমন নয়; অথাৎ মহাশূন্য বলতে যা বােঝায় তা নয়। অতি বিরলভাবে অবস্থান করছিল এক ধরণের আদিম কণিকা। আর ব্রহ্মান্ডটার ব্যাপ্তিও নেহাৎ কম ছিল না, যদিও আজকের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ ছিল। আদিম কণিকাগুলাে প্রকৃতপক্ষে কী যে ছিল, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত নন। তবে কোন না কোন সময়ে আভ্যন্তরীণ কণিকাগুলাের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। কয়েক আলােকবর্ষ ব্যাপী ব্যাপ্তির মধ্যে অস্থিরতা যে কোন কারণে আসতে পারে এবং এই অস্থিরতার দরুণ আদিম কণিকাগুলাে এক বিশাল আয়তনের মধ্যে জড় হওয়ার সুযােগ পায়। পরে এটি আবর্তন করতে শুরু করলে সেগুলাে জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং প্রকাশ পায় আকর্ষণ বল। পরে আবর্তন বল প্রবল থেকে প্রবলতর হলে ব্রহ্মান্ডের বিশেষ এক জায়গায় জমাট বাঁধা পিন্ডের আকারে অবস্থান করে। এক সময় তার ঘনত্ব দাঁড়ায় পানির ১০ গুণের মত এবং সেই পিন্ডটি যে অংশে সীমাবদ্ধ ছিল তার ব্যাস ছিল কম করে ৩০ কোটি মাইলের মত।


আবর্তন করতে করতে আরও সে নিবিড় ঘনত্বের দিকে এগিয়ে যায় এবং তাপমাত্রাও বেড়ে উঠে অকল্পনীয়ভাবে। পরিশেষে তাপ ও ঘনত্ব এতখানি বেড়ে ওঠে যে, তাতে পিন্ডটা নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ঘটেছিল প্রচন্ড এক বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণের ফলে মুলপিন্ডটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে অজস্র খন্ডে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাকাশের চতুর্দিকে। সেই বিস্ফোরণ থেকেই ব্রহ্মান্ড প্রসারিত হতে শুরু করেছে।. বিজ্ঞানীদের মতে সেই প্রসারণ অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে না। প্রসারণের নির্দিষ্ট একটা সীমা থাকা সম্ভব। সেই সীমায় এসে পড়লে পুনরায় শুরু করে সঙ্কুচিত হতে। সংকোচনের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় বিশ্বের প্রতিটি বাসিন্দা। তারপর সেই সঙ্কোন একদিন শেষ সীমায় পৌঁছায়। বস্তু কণাগুলাে একজায়গায়  জড় হয়। আবার সেই জমাট বাঁধা পিণ্ড, আবার বিস্ফোরণ, আবার নতুন করে। সৃষ্টি।


আদিম সেই বিস্ফোরণের কথায় আসা যাক। প্রথম যখন বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তখন সেই আদিম কণিকা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ইলেকট্রন, প্রােটন, নিউট্রন এবং তাদের কিছু কিছু বিপরীত কণা। পরে সেই কণাগুলাে থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুরা। যেহেতু বিশ্বের প্রসারণ অব্যাহত ছিল, সেগুলাে ঘনীভুত হয়েছে, জমাট বেঁধেছে এক একটা পিন্ডের আকারে, বিস্ফোরণ ঘটেছে তাদের মধ্যেও। তারই ফলে সৃষ্টি হয়েছে মহাকাশের সহস্র সহস্র কোটি নক্ষত্র জগৎ বা গ্যালাক্সী।


Post a Comment

Previous Post Next Post