রেডার(Radar)কি কোনো কিভাবে আবিষ্কার হলো।

 রেডার


কখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে প্রয়ােমে। বোমারু বিমান এগিয়ে আসত ঝাঁকে অকে, আর সামরিক টি এবং সমৃদ্ধ জনপদগুলির উপর বেপরোয়াভাবে গুলি ও বােমাবর্ষণ করে নিবিবাদে সরে পড়ত। ব্যাপারটা এমন অতর্কিতে ঘটে যেত যে, কোনরকম সাবধান হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেত না। মারণাঞ্জগুলােকে এড়িয়ে। কৌশলে কাজ হাসিল



করত। অনেক ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। হানাদারদের আক্রমণকে যেমন করে হােক হতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবেন তেমন শক্তিশালী হাতিয়ার ? হঠাৎ মনে। তাদের বেতার তরঙ্গের কথা। তাঁরা জানতেন, বেতার তরঙ্গ আলাে কিংবা শব্দের মত প্রতিফলিত হয়। আরও জানতেন, পর্বত, বনভূমি, আকাশের মেঘ, এমনকি বিমান গাত্রেও প্রতিফলিত হতে পারে। যন্ত্রের দ্বারা বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন করে যদি শত্রুপক্ষীয় বিমানের গায়ে প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে তাহলে অবশ্যই বিমানের দূরত্ব নির্ণয় করা যাবে।


সে চেষ্টাও সফল হল বিজ্ঞানীদের। অচিরে আবিষ্কার করলেন রেডার নামে একটি যন্ত্র । তবে আরও একটা সমস্যা ছিল। সে সমস্যাটা হচ্ছে দূরত্ব নির্ণয় করা । কোন শব্দকে প্রতিফলিত করিয়ে দূরত্ব নির্ণয় করা সহজ। কারণ শব্দের * বেগ সেকেন্ডে ১১২০ ফুট মাত্র। সেক্ষেত্রে বেতার তরঙ্গের গতিবেগ সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। অল্প সময়ে এত বেশী পথ অতিক্রম করে যে, সময়টা নির্ণয় করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।



অনেক ভেবে-চিন্তে বিজ্ঞানীরা এ সমস্যাটিরও সমাধান করলেন। আবিষ্কার করলেন এক ধরনের বিদ্যুত্তালিত যন্ত্র-যার সাহায্যে আপনা হতেই সময়টা ধরে পড়ে গেল।


“রেডার" এই নামটি একটা ইঙ্গিত বহন করছে। ওর পুরাে নাম IRadio Detection and Ranging" । যুদ্ধের সময় বেতার তরঙ্গের সাহায্যে সামরিক বিভাগ আকাশে বিমান এবং শতুপক্ষীয় গােপন ঘাটিগুলির অনুসন্ধান চালাতাে বলে এই ধরনের নামকরণ হয়েছিল। Radio Detection and Ranging এর সংক্ষেপিত নাম “Radar'"।


রেডার নামে অভিহিত যন্ত্রটি কোন একটিমাত্র বিশেষ যন্ত্র নয়। এটি কতকগুলি যন্ত্রের একটি বিন্যাস। যন্ত্রগুলির মধ্যে একটা বেতার প্রেরক্ন্ত্র, একটা বেতার গ্রারকযন্ত্র, একটা আকাশ তার বা এ্যারিয়েল বা অসিলােস্কোপই প্রধান। বেতার প্রেরকযন্ত্র থেকে বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয় এবং সেই তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় ধরা পড়ে এখানকার বেতার গ্রাহক যন্ত্রে। এই কারণে৷ কিছুক্ষণ পর পর আকাশ তারের সাহায্যে বেতার ধ্বনি উৎক্ষিপ্ত করা হয় এবং সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে প্রতিবনি শােনার চেষ্টা করা হয়। এই সময়টা বেতার প্রেরক্যন্ত্র থেকে বেতার তরঙ্গ পাঠান হয় না। কিছুক্ষণ বিরাম দেওয়া হয় বলে একই আকাশ তারকে শব্দ প্রেরণ ও শব্দ গ্রহণ উভয় কাজেই ব্যবহার করা হয়। তার জন্য থাকে ইলেকট্রিক সুইচের ব্যবস্থা।



আকাশ তারটির গঠনটা একটু বিশেষ ধরনের। অবতল একটা ফ্রেমে আকাশ তারটি জড়ান থাকে, যাতে সুইচ টিপলেই এদিক ওদিক ঘুরতে পারে। বেতার তরঙ্গ পাঠানাের সময় অবতল ফ্রেমটা একটা বিশেষ দিকে ঘুরতে পারে। প্রতিধ্বনি শােনার সময় আপনা হতেই অন্যদিকে ঘুরে আসে।


বেতার প্রেরক্যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে আর একটি যন্ত্র। নাম তার অসিলােস্কোপ। আসলে অসিলােস্কোপ যন্ত্রটিকে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রই বলা যেতে পারে। এই যন্ত্রটির প্রথম কাজ হচ্ছে সময় ও দূরত্ব পরিমাপ করা । যখন। বেতার ধ্বনি পাঠান হয়, তখন যন্ত্রটির গায়ে একটা কাচের পর্দার উপর দীর্ঘ আলােক রেখা পড়ে। আবার যখন প্রতিধ্বনি ফিরে আসে তখন পর্দাটার উপর পূর্ব আলােক রেখা থেকে দূর আর একটা খাটো আলােক রেখা দেখা যায়। এই আলোক রেখার ব্যবধান নির্দেশ করে সময়ের পরিমাপ। সময় জানতে পারলেই পূর্বোক্ত উপায়ে দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। বস্তুটি যদি গতিশীল হয় তাহলেও ধরা পড়ে এই যন্ত্রে এবং তার গতিবেগও আপনা হতে নির্দেশ করে। রেডারে ব্যবহৃত বেতার তরঙ্গের দৈর্ঘ্য সাধারণতঃ ৩ সেন্টিমিটার থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। রেডারের উদ্ভাবন হয়েছে ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য। আজ কিন্তু যে কোন রাষ্ট্রের জন্যে রেডার অপরিহার্য। দেশ রক্ষার কাজে রেডার না হলে একদন্ডও চলবে না।



নিজের দেশের জাহাজ ও বিমান শ্রেণীকে ঠিক পথে পরিচালিত করতেও রেডারের প্রয়ােজন হয়। মাঝ সমুদ্রে অনেক সময় কুয়াশায় দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে জাহাজ। তখন অন্য কোন জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়াও অসম্ভব নয়। এই অবস্থায় জাহাজকে নিয়ন্ত্রিত করতে হয় রেডার যন্ত্রের সাহায্যে। আবহততুবিদদের রেডার ছাড়া এখদন্ডও চলে না। দূর সমুদ্রে কোথাও ঝড় কিংবা ঘূর্ণিবাত্যা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সে কথা রেডার আমাদের জানায় পূর্বাহ্নে। ঝড়ের উৎপত্তিস্থল এবং গতিবেগ উভয়ই নির্ণয় করা হয় রেডার যন্ত্রে যেমন করে শত্রুপক্ষর বিমানের অবস্থান এবং গতিবেগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার ফলে আমাদের কত যে উপকার হয়েছে, সে কথা কে না জানে ? সমুদ্র তীব্রবর্তী জনসাধারণ, সমুদ্রের মাঝিমাল্লা এবং বিমান বন্দর আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে আগে থেকে সাবধান হয়ে যায়। যার জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার জীবনহানি বন্ধ হয়েছে এবং বহু জাতীয় সম্পদ রক্ষা পাচ্ছে।


জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও ব্যবহার করছেন রেডারকে। তাঁরা নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহাদির দূরত্ব নির্ণয় করছেন রেডারের জারা। আকাশে দৈনন্দিন উল্কাপাতের পরিমাণও জানাচ্ছে রেডার। এক কথায় মহাকাশের খবর সংগ্রহের কাজে রেভারের আছে প্রধান ভূমিকা।

বর্তমানে মানুষ আবার মহাকাশ পরিক্রমার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে। আকাশে প্রায়ই উৎক্ষিপ্ত করা হচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহকে। সেই সব উপগ্রহ ঠিক পথে চালিত হচ্ছে কিনা, পৃথিবীর মাটিতে বসে মানুষ এই রেডার থেকেই সংগ্রহ করছে। কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্যেও স্থাপন করা হয় রেডারকে। যার জন্য কেবল পৃথিবী নয়,বহিবিশ্বের নানাবিধ খবর আমরা ঘরে বসেই সংগ্রহ করতে পারছি।


স্বীকার করতে হবে যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে রেডার একটি উল্লেকযােগ্য অবদান। রেডার আবিষ্কৃত না হলে মহাকাশবিজ্ঞান এতখানি সমৃদ্ধ হতে পারত না। মহাকাশ পরিক্রমায়ও দেখা যেত নানা বাধা-বিপত্তি। ভবিষ্যতে রেডারের দ্বারা আরও বহু কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করেন বিজ্ঞানীরা।


Post a Comment

Previous Post Next Post