দূরবীন
দূরবীনের আবিষ্কার হয়েছে অনেক আগে, সেই কোন স্মরণাতীত কালে। তবে সে দূরবীন কেমন ছিল জানা যায় না। আধুনিককালে লিপারশী নামে হল্যান্ডের এক চশমা প্রস্তুতকারকই দূরবীনের প্রকৃত আবিষ্কারক। তিনি
ধাতুনির্মিত একটা সরল চোঙের তলায় লেন্স বসিয়ে ঠিক দূরবীন না হলেও দূরবীনের মত একটি যন্ত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেটা ছিল ইংরাজী ১৬০৮ সাল । দু-বছর পরে অর্থাৎ ইংরাজী ১৬১০ সালে ইটালীর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী
গ্যালিলিও সেই চশমা প্রস্তুতকারক লিপারশীর যন্ত্রের অনুরূপ আর এক ধরণের দূরবীন তৈরি করেন। এটিও ছিল ধাতুনির্মিত একটি সরল চোঙ। তবে একটি লেন্সের বদলে দুটি লেন্স ব্যবহার করেছিলেন গ্যালিলিও। চোঙের তলায় যুক্ত করেছিলেন একটি বড় লেন্স এবং উপরে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র আর একটি লেন্স। সেদিন নিজের তৈরি দূরবীন নিজের চোখে লাগিয়ে রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন গ্যালিলিও। অবাক হয়েছিলেন নিজেই। অকল্পনীয় মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র অংশের ছবি সেই প্রথম মানুষের চোখে ধরা পড়েছিল। গ্যালিলিও কেবলমাত্র নিজে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি, ডেকে এনেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের। আকাশকে দেখে তারা এমন আশ্চর্য বােধ করেছিলেন যে, মনে হয়েছিল বুঝিবা গ্যালিলিও ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন ততক্ষণ।
গ্যালিলিওকে অনেক কষ্টে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন না। বন্ধুরা যা দেখেছিলেন, সেইটিই আকাশের প্রকৃত খবর। তবুও গ্যালিলিওর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেননি কেউ।
গ্যালিলিওর পর অতিবাহিত হয় কত শত শত বছর। বিজ্ঞানের পরিধিও বেড়ে চলে অতি দ্রুতগতিতে। ফলে গ্যালিলিওর দূরবীন বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং শিল্পীদের হাতে নবরূপ পরিগ্রহ করে এবং তাঁর অনুকরণে তৈরি হয় আরও হরেক রকমের দূরবীন। আজকের দিনে যে পূরবীন ব্যবহার করা হয়, সে দূরবীনের সঙ্গে গ্যালিলিওর দূরবীনের আকৃতিগতভাবে কোন মিল নেই। তবুও দূরবীনের প্রকৃত আবিষ্কারকরূপে গ্যালিলিওর নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বর্তমানকালে দূরবীনকেও ব্যবহার করা হয় আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য। এই
দূরবীন দু-ধরণের তৈরি করা হয়। এক ধরণের দূরবীনের নাম "প্রতিসরিত
আলাের দূরবীন", দ্বিতীয় ধরণের নাম “প্রতিফলিত আলাের দূরবীন । উভয় প্রকার দূরবীনে লেন্স লাগাতে হয়। তবে প্রতিসরিত আলাের দূরবীনে ব্যবহার করা হয় উত্তল লেন্স এবং প্রতিফলিত আলাের দূরবীনে ব্যবহার করা হয় অবতল লেন্স। লেন্স মাত্রেই কাচের তৈরি এবং উভয় লেন্সই গােলাকার। উত্তল লেন্সের মাঝখানটা মােটা কিন্তু কিনারার দিকে ক্রমশঃ পাতলা হয়ে গেছে। অবতল
লেন্সের বেলায় সম্পূর্ণ উল্টো, অর্থাৎ কিনারার দিকটা বেশ মােটা ভেতরের দিকে
ক্রমশঃ পাতলা। আমরা যে আতস কাচ ব্যবহার করি সেটি একটি উত্তল লেন্স।
অবতল লেকে কখনও কখনও চশমা! লালহার করা হয়। অবতল লেন্স বেশ কয়েক ধরণের হয়ে থাকে। কারও এক পিঠ অবতল আধ এক পিঠ সমতল কারও বা দু’পিঠ অবতল, আর কারও কারও এক পিঠ গুগুল অপর পিঠ অবত। প্রতিফলিত আলাের দূরবীনে যে অবতল লেগটি ব্যবহার করা হয়, তার এক পাশ থাকে সমতল এবং অপর পাশ অবতল মাত্র।
প্রতিসরিত আলােৱ দুৱৰীনে একটা বড় লেন্স এবং একটা ছোট লেন্স ব্যবহার করা হয়। দূরবীনের যে মুখে বy লেন্স লাগান পাকে সেটিকে নির্দিষ্ট রাখতে হয় লক্ষ্য বস্তুর দিকে। তাই এই লেন্সটিকে বলে অঝেই গ্লাস। আর দূরবীনের যে মুখে চোখ রেখে দেখতে হয়, সেখানে বসান থেকে ছােট লেন্পটি। এই লে্সটিকে বলা হয় আই পিস। দূরবীনটি তৈরি হয় ধাতুনির্মিত একটা চো দিয়ে। তবে প্রতিসরিত আলাের দূরবীন করতে যথেষ্ট নিপুণতার প্রয়ােজন। লেন্স দুটিকে এমনভাবে স্থাপন করতে যেন উভয়ের ফোকাস একই বিন্দুতে মিলিত হয় এবং অক্ষয় একই সমতলে থাকে।
এই জাতীয় দূরবীনে দূরের জিনিসকে অনেকটা কাছে দেখায় এবং ঐ কারণে কিছুটা বড়ও দেখায়। প্রতিসরিত আলাের দূরবীন চোখে লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকালে গ্রহ উপগ্রহরা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে যা দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বড় দেখায়। কিন্তু নক্ষত্ররা অত্যধিক দূর অবস্থান করার জন্য আদৌ বড় দেখায় না। তবে কিছুটা ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়। এই দূরবীনকে প্রতিসরিত আলাের দূরবীন বলা হয় এই কারণে যে, এতে ব্যবহৃত লেন্সে আলাের প্রতিসরণ ঘটে।
এই জাতীয় দূরবীনের অবজেক্ট গ্লাস বড় করে তৈরি করার আরেক অসুবিধা
আছে। সেইজন্য আজ পর্যন্ত যত প্রতিসরিত আলাের দূরবীন তৈরি হয়েছে,
তাদের অবজেক্ট গ্লাসের ব্যাস তিন ইঞ্চি থেকে চল্লিশ ইঞ্চি পর্যন্ত। তৈরি করার
একটা বড় অসুবিধা হচ্ছে, এত বড় কাচখন্ডকে ঢালাই করা। ঢালার সময় যদি সামান্য একটু বুদবুদও থেকে যায়, তাহলে সে লেন্সকে ব্যবহার করা যাবে না। বড় কাচখন্ড ঢালাই করতে গেলেই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও বুদবুদ থেকে যায়। প্রতিসরিত আলাের দূরবীনের মধ্যে চিকাগাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়েস মানমন্দিরের দূরবীনটি পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ দূরবীন। ঐ দূরবীনটির অবজেক্ট গ্লাসের ব্যাস ৪০ ইঞ্চি।। অবজেক্ট গ্লাসের ব্যাস বেশী হলেই দূরবীন শক্তিশালী হয়। তার কারণ হচ্ছে দূরে কোন নক্ষত্রের আলো আমাদের চোখের মণিতে
যতখানি পড়ে, দূরবীনের অবজেক্ট গ্লাসে পড়ে তার চেয়ে শত গুণ বেশী। তাই
দূরবীনের সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণ করলে নক্ষত্রদের বেশী উজ্জ্বল দেখায় এবং
গ্রহদের বড় দেখায় ।
প্রতিফলিত আলাের সূধীনেৰ গঠন প্রণালী প্রায় একই ধরণের। এখানেও খ খতিব মলে দরকার হয়, তবে অবলোপটি উন না হয়ে অনত হয়ে থাকে। উজল অশে অবতল লেপ তৈৰি কৰাত সুবিধা থাকায় এই দূরবীনের অজেই গ্লাসের ব্যাশ বেশ বেশী। তবে এখানে অবতল লেকে অবতল দর্পণে পরিণত করে বাবহায় করা হয়।
অব দখি তৈরির নিয়ম হচ্ছে, প্রথমে মাপ অনুযায়ী এটা বৃত্তাকার ও পুত কাজকে চালাই করে নিতে হয়। তারপর কাচ পশুটির একটা পিঠ ঘষে যায়ে অবতল করে নেওয়া হয়। ঘষার সময়ে সাবধানতা অবশ্যই অবলম্বন করতে হয়, যেন নিয়ম অনুযায়ী পুরু হয় অর্থাৎ পাশের দিক অপেক্ষা কেন্দ্রের নিকে পাতলা হয়। কোথাও পাতলা কিংবা কোথাও পুরু এ ধরণের হলে চলবে না। তাছাড়া অপরাপর ক্রটি তাে আছেই।
অবতল কাচখন্ড তৈরি করার পর অবতল পিঠের উপর রূপা অথবা অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা আস্তরণ দিয়ে দেওয়া হয়। তা হলেই তৈরি হয়ে যায় অবতল দর্পণ। আজ পর্যন্ত যত প্রতিফলিত আলাের দূরবীন তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দূরবীনটি হল মাউন্ট প্যালােমারে রাখা ২০০ ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীনটি । ঐ দূরবীনটির সাহায্যে দুশ কোটি আলােক বর্ষ দূরে অবস্থিত নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। শােনা যায়, এটি তৈরি করতে বহু কুশলী শিল্পীর বিশ বছর সময় লেগেছিল।
আমেরিকার লিক মানমন্দিরে স্থাপিত দূরবীনটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দূরবীন। ঐ দূরবীনটির অবজেক্ট গ্লাসের ব্যাস ১২০ ইঞ্চি । সম্প্রতি সােভিয়েত রাশিয়া ও তৈরি করেছে ২০০ ইঞ্চি ব্যাসের অবজেক্ট গ্লাসযুক্ত আরও একটি বৃহত্তম প্রতিফলিত আলাের দূরবীন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন মানমন্দিরেও আছে দূরবীন। তবে তাদের কোনটিই এত বড় নয়।
আজকাল বিভিন্ন দেশে প্রতিফলিত আলাের দূরবীনকে অবলম্বন করে প্রস্তুত করা হচ্ছে বেতার
দূরবীক্ষণ যন্ত্র। নাম থেকেই বােঝা যাচ্ছে, মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য দূরবীনের সঙ্গে বেতার তরঙ্গকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। রেডারের কথা আলােচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বহির্বিশ্ব থেকে আগত বেতার তরঙ্গ রেডার যন্ত্রের আকাশতারে ধরা পড়ে। কিন্তু সে তরঙ্গ বড়ই দুর্বল। বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্রে যে আকাশতার ব্যবহার করা হয়, সেটি তীক্ষ অনুভূতিসম্পন্ন । জ্যোতিষ্ক থেকে আগত আলােকরশ্মি দূরবীনের অবতল দর্পণে এসে পড়লে সমস্ত রশ্মি একত্রভাবে প্রতিফলিত হয়ে দর্পণের ফোকাস বিন্দুতে জড় হয়। একটি বিন্দুতে সব রশ্মি সমবেত হওয়ার ফলে দুর্বল রশ্মিও শক্তিশালী হয়ে পড়ে। অপর দিকে জ্যোতিষ্ক থেকে আগত বেতার তরঙ্গ প্রতিফলনের জন্য বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্রে একটা অবতল আকাশতার এবং একটি বেতার গ্রাহকযন্ত্র ব্যবহার করা হয়।

