বজ্রনিরােধক(Lightning insulation)কি কোনো কিভাবে আবিষ্কার হলো।

 বজ্রনিরােধক।


বাজের প্রতি ভয় মানুষের চিরকালের। আদি মানবের আমল থেকে একরকম সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত আকাশের ঐ বর্জ্য যে কী তা কারও জানা ছিল না। জানবেই বা কেমন করে? মানুষের হাতে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি, বিদ্যুৎ সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না, বিদ্যুতের আশ্চর্য ক্ষমতা কল্পনারও বাহিরে ছিল। একদিন শুভক্ষণে বিজ্ঞানীরা স্থির তড়িৎ সম্বন্ধে জ্ঞাত হলেন। বিজ্ঞানের এই নতুন দিকটাকে নিয়ে শুরু করলেন নানাজনে গবেষণা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামে এক ব্যক্তি নবাবিষ্কৃত স্থিরতড়িতের প্রতি বেজায় আকর্ষণ অনুভব করলেন। শুরু করলেন এ বিষয়ে পড়াশােনা এবং যন্ত্রপাতি কিনে গবেষণা শুরু করে দিলেন।প্রায় আট বছরকাল বেজ্ঞামিন ব্যাপৃত ছিলেন এই কাজে। এইসময় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের অন্যান্য বিজ্ঞানীর মত সন্দেহ হয়, তাঁদের তৈরি বিদ্যুতের সঙ্গে আকাশের বিদ্যুতের যেন কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তড়িং যেমন কোন পরিবাহীর মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে, তেমনি আকাশের বিদ্যুৎও বড় বড় গাছ, কারখানার চিমনি ইত্যাদিকে অবলম্বন করে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। তড়িৎ যেমন কোনকিছুকে পুড়িয়ে দিতে পারে, ধাতুকে গলাতে পারে, একাধিক পথে সঞ্চালিত হতে পারে, তেমনই আকাশের বিদ্যুৎও পারে। এবার পরীক্ষা করে দেখার পালা বেঞ্জামিন স্থির করলেন, গভীর চিন্তার পর একটা সরঞ্জাম বানালেন, তারপর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে রইলেন একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য-যেদিন কালােমেঘে ঢাকা পড়বে। আকাশ, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাবে,আর কড় কড় করে বাজ পড়বে।



১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে তেমনই একটি দিন এলাে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ক্ষণে ক্ষণে প্রভা দান করছে ক্ষণপ্রভা, আর মেঘ ডাকছে গুরু গুরু রবে। ফ্রাঙ্কলিন এই সুযােগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জন্য বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে। আগেই তৈরি করা ছিল সিল্কের রুমাল দিয়ে তৈরি একটা ঘুড়ি। ঘুড়িটির মাথায় বাঁধা ছিল সুঁচলাে অগ্রভাগবিশিষ্ট একটা লােহার দন্ড, আর তড়িৎ সংগ্রাহক যন্ত্র লীডেনজার। ফ্যাঙ্কলিন লম্বা সুতাে দিয়ে ঘুড়িটা আকাশে ওড়ালেন। সুতাের অন্যপ্রান্তে সিল্কের ফিতে বেঁধে যুক্ত করেছিলেন লীডেনজারের সঙ্গে। যা ভেবেছিলেন তাই-ই হলাে। একটু পরেই লীডেনজার নির্দেশ দিল তড়িতের। নিজ হাতেও অনুভব করলেন তড়িতের শক। নিশ্চিন্ত হলেন তিনি এবং তার পরীক্ষার কথা প্রচার করলেন বিজ্ঞানীদের মধ্যে। বললেন, সূঁচলাে অগ্রভাগবিশিষ্ট লৌহদন্ডের মাধ্যমে আকাশের বিদ্যুৎকে নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনা যায়।


চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। অনেকেই ফ্রাঙ্কলিনের মত আকাশের বিদ্যুৎকে মাটিতে নামিয়ে আনতে আগ্রহী হলেন। কিন্তু পরের বছর একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সেন্ট পিটাসবার্গের জর্জ রিখম্যান নামে এক বিজ্ঞানী আকাশের বিদ্যুৎকে নামাতে গিয়ে তড়িৎপৃষ্ঠ হয়ে মারা গেলেন। শােনা যায়, পরীক্ষা চালানাের কালে বেঞ্জামিনও অতি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন।


আকাশের তড়িৎকে পরীক্ষা করার পর বেঞ্জামিনের চিন্তা অন্যখাতে প্রবাহিত হলো। বাজ পড়ে বহু পুরাকীর্তি, বহু বাড়ী নষ্ট হয়ে যায় যদি সূঁচলাে অগ্রভাগবিশিষ্ট ধাতবদন্ডকে বাড়ীর মাথার উপর থেকে সরাসরি মাটিতে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ মাটিতে নেমে আসবে এবং বাড়ীটির কোন ক্ষতি হবে। জন প্রিঙ্গল জানতেন তিনি যা করলেন রাজারােয অবশ্য বর্ষিত হবে এবং সভাপতির পদও তাঁর থাকবে না। তাই রাজার কাছে মতামত ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন এবং পদত্যাগ পত্রটি পাঠিয়ে দিলেন রাজার কাছে। বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন জন প্রিঙ্গল। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল তাঁরই এবং জয় হয়েছিল উক্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উচ্চতা বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিনের তাই এখনও সব দেশে প্রচলিত আছে সূঁচলাে মুখওয়ালা বজ্রনিরােধক।

Post a Comment

Previous Post Next Post