হীরে মণি মুক্তো(Diamonds are pearls)কি কোনো কিভাবে আবিষ্কার হলো।

 হীরে মণি মুক্তো


মণি সাপের মাথায় থাকে না, অজানা সেই রাজকন্যার চোখ থেকেও ঝরে না, মণি থেকেই মণি পাওয়া যায়- হীরে যাকে বলে। আর উন্নত মানের হীরকই মণি নামে পরিচিত; যেমন কোহিনুর মণি। কোহিনুর তুল্য দ্বিতীয় মণি পৃথিবীতে নেই। হীরে কয়লারই রূপভেদ। পৃথিবীর অর্ধেক জায়গায় হীরকের খনি আছে। এর ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকেই। প্রাচীন নগর সভ্যতার যুগে রাজা ও রাণীরা হীরের অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। দেখতে ভারি সুন্দর, সহজে নষ্টও হয় । শত-সহস্র বছর ধরে ঔজ্জ্বল্য তেমনই অম্লান থাকে। তাইতাে ওদের কদর এত বেশী। তার উপর অতি শক্ত পদার্থ-কাচকেও কাটতে পারে। তাই হীরের চেয়ে শক্ত পদার্থ এখনও কিছু পাওয়া যায়নি। রত্ন হিসেবে ওর বিশেষ প্রসিদ্ধি রয়েছে।



রত্ন হিসেবে আরও কতকগুলাে জিনিসকেও মানুষ খাতির করে। সেগুলােও মূল্যবান, কঠিন এবং দেখতেও সুন্দর। তাই তাদের নামের শেষে মণি কথাটা যুক্ত করা হয়েছে। নীলকান্ত মণি, বৈদুর্যমণি, চন্দ্রকান্ত মণি, মরকত মণি, গােমেদ মণি ইত্যাদি নাম। এদের উপাদান কিন্তু হীরের মত কার্বন বা কয়লা নয়। বেশীরভাগের মূল উপাদান অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড। আজ পর্যন্ত প্রায় ১০০ রকমের ঐ জাতীয় রত্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। এরাও সহজলভ্য নয়। কিছু কিছু আগ্নেয় ও পাললিক শিলায় পাওয়া গেলেও বেশীরভাগ পাওয়া যায় রূপান্তরিত শিলায়। এদের সবাইও বেজায় কঠিন। কাঠিন্যের দিক থেকে হীরের স্থান প্রথম। হীরের কাঠিন্য ধরা হয়েছে ১০। কাঠিন্যের দিক থেকে চুনির ৯, বৈদুর্য মণির সাড়ে ৮, পান্না ও পোখরাজের ৮, গােমেদের সাড়ে ৭। হীরের কাঠিন্য বেশী হওয়ায় সে পরবর্তীদের গায়েও দাগ কাটতে পারে।


না, হীরে বিষাক্ত নয়। হীরকচূর্ণ খাইয়ে কাউকে মারা যায় না, হীরকের আংটি চুষে আত্মহত্যাও করতে পারে না কেউ। এগুলি গপূপাে, গপূপের ঘােড়া যেমন আকাশে উড়ে বেড়ায়, এও তেমনই। স্রেফ কল্পনা।


হীরেই হােক, আর চুনি পান্নাই হােক, ওদের সৌন্দর্য নির্ভর করে কাটা ও পালিশ করার উপর। প্রকৃত জহুরীর হাতেই ওদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। হীরের দামও নির্ভর করে বিশেষ কোণে পল করে কাটার উপর এবং পালিশের উপর। হীরককে সাধারণতঃ ৪১ ডিগ্রী কোণ করে পল কাটা হয়। এতে আলাে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। তখনই ঝকমক করে এবং সৌন্দর্যটা আমাদের চোখে ধরা পড়ে। আলাে ঠিকরে বেরিয়ে আসা মানেই আলাের প্রতিসরণ ঘটা হীরে স্বচ্ছ এবং এর প্রতিসরাঙ্ক ২.৪২। অন্যান্য রত্ন পাথরদের প্রতিসরাঙ্ক ২ থেকে কম। হীরে স্বচ্ছ কিন্তু অন্যান্যদের নিজস্ব রঙ আছে। পান্না বা মরকত মণির রঙ সবুজ, চনি বা রুবি লাল রঙের, নীলা বা নীলকান্ত মণি নীল রঙের, বৈদু্যমণি বা ক্যাটস আই বেড়ালের চোখের মত, গােমেদ খয়েরি রঙের, প্রবাল গাঢ় লাল রঙের ইত্যাদি। ঐসব মণিদের নিয়ে প্রায় সব দেশেই কিছু না কিছু সংস্কার আছে। যেমন বলা হয়ে থাকে- নীলা কারুর সহ্য হয়, আবার কারুর সর্বনাশ ঘটায়। এমনকি পরিবারেরও। ঐ সংস্কারগুলােকে নিয়ে বহু লােমহর্ষক কাহিনীও গড়ে উঠেছে। সেগুলাে ভিত্তিহীন, অর্থাৎ বিজ্ঞান খুঁজে পায়নি। কোহিনুরকে ঘিরেও সংস্কার আছে।


এমন যে মূল্যবান পদার্থগুলাে-তাদের কৃত্রিমভাবে তৈরি করতেও বিজ্ঞানীরা সচেষ্টা হয়েছেন, তৈরিও করেছেন। রত্ন পাথর তৈরি করা কোন সমস্যাই নয় । নীলাকে তৈরি করা হয় অতি মিহি ও বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের গুঁড়ােকে গলিয়ে, ৬ ভাগ বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের গুঁড়াের সঙ্গে ৫ ভাগ ক্রোমিয়াম অক্সাইডের গুঁড়াে মিশিয়ে এবং উচ্চতাপে গলিয়ে চুনিকে তৈরি করা হয়। রত্ন ব্যবসায়ীরা এবং জ্যোতিষীরা হয়ত ক্ষেপে যাবেন। বলবেন, এরা প্রাকৃতিক নয় এবং রত্ন হিসেবে কোন মুল্য নেই। আসলে, তাঁরা বােধহয় জানেন না, কিংবা জেনে অস্বীকার করেন, দোকানে ঝুড়ি ঝুড়ি যে পাথরগুলাে বিক্রি হয় তাদের অধিকাংশই কৃত্রিম।


হীরেকেও তৈরি করা যায়। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে সর্বপ্রথম হেনরি ময়সা কৃত্রিম হীরক তৈরি করেছিলেন। বিশুদ্ধ চিনি, কয়লা ও লৌহচূর্ণকে নিয়ে বৈদুতিক। চুল্লীতে উত্তপ্ত করেছিলেন তিন হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে। ওতে মিশ্রণটা গলে গিয়েছিল এবং সহসা ঐ মিশ্রণটাকে শীতল করে ফেলেছিলেন। অতি উচ্চ তাপমাত্রায় চিনি কয়লা থেকে যেটুকু কার্বন গলিত লােহায় দ্রবীভূত হয়েছিল, হঠাৎ শীতল করার ফলে তারই একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কেলাসের আকারে। ঐ কেলাসই হীরক। অনুরূপ উপায়ে প্রাপ্ত হীরকের কিন্তু বাজার দাম নেই। টুকরােগুলাে অতি ক্ষুদ্র। ওর উপর পল কাটাও যায় না, পালিশ করাও সম্ভব হয় না। কেবলমাত্র হীরকের বড় টুকরোগুলােই রত্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হীরক খন্ডটির নাম কুলিনাল, ওজনে ৩০৩২ ক্যারেট (১ ক্যারেট= ০-২ গ্রাম)। কিংবদন্তীর নায়ক কোহিনুরের ওজন ছিল ১৩৬-২৫ ক্যারেট। এবার মুক্তোর কথায় আসা যাক। মুক্তোর সঙ্গেও মানুষের পরিচয় অনেককালের। রত্ন হিসেবে মুক্তোরও সুখ্যাতি আছে। শােনা যায়, প্রাচীনকালে রাজ-রাজড়াদের রত্নভান্ডারে মুক্তোর ছড়াছড়ি ছিল। মুক্তোকে রত্ন হিসেবে ধরা হলেও অন্যান্য রত্নের সঙ্গে ওর প্রভেদ বিস্তর। প্রবালও তাই। অন্যান্য মূল্যবান রত্নের সঙ্গে মুক্তোকে কবে যে মানুষ অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং কেমন করে সংগ্রহ করতাে-তা ঠিক করে কিছু বলার উপায় নেই। তবে মুক্তো সম্বন্ধেও নানা গাল গল্প গড়ে উঠেছিল। এই সেদিনও পর্যন্ত অনেকে মনে করতেন হাতীর মাথায়। ভেতরে মুক্তো জন্মায়- নাম গজমুক্তো। গল্প অনুযায়ী সব হাতীর মাথার পাওয়া যায় না; দৈবাৎ এক একটির মাথায়। তার মানে কারুর মাথায় নয়।


মুক্তো পাওয়া যায় ঝিনুকের ভেতর থেকে এবং এ কথাটা অনেক আগে। থেকেই মানুষ জানতাে। কোন কোন দেশ মনে করতাে, সমুদ্রের ঝিনুকরা রাতের বেলায় বেলাভূমিতে উঠে এসে শিশির বিন্দু পান করে। সেই শিশির ওদের পেটে গেলে রূপ নেয় মুক্তরা। আজও বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষ মনে করেন, আশ্বিণের সংক্রান্তিতে গভীর রাতে আকাশ থেকে নেমে আসে মাত্র কয়েকবিন্দু বিশেষ ধরনের শিশির। ঐ শিশির সাপের মাথায় পড়লে সাপের মাথায় মণি গজায়, হাতীর মাথায় পড়লে মুক্তো গজায়, ঝিনুকের উপরে পড়লেও মুক্তো হয়, ইত্যাদি।


এইসব ভ্রান্ত ধারণা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। লিনে নামে একজন ফরাসী বিজ্ঞানীই প্রথম উঘাটন করেছিলেন মুক্তোর রহস্য। সব রকমের ঝিনুক মুক্তো তৈরি করতে পারে না। পার্লঅয়েনস্টার নামে এক ধরনের সামুদ্রিক ঝিনুকই মুক্তো তৈরি করতে সক্ষম। চলতি কথায় আমরা ওদের বলি শুক্তি। সব ঝিনুকেরই শরীরটা থলথলে জেলির মত। দুটি খােলকের ভেতরে আবদ্ধ রাখে নরম ও থলথলে শরীরটাকে। কিন্তু জীব-ততা! খােলকের ভেতরে গুটিয়ে থাকলে চলে না। এখানে ওখানে চলাফেরা করতে হয়, খাদ্য অন্বেষণ করতে হয়, শত্রুর চোখে ধুলােও দিতে হয়। তাই খাদ্য খুঁজতে খােলক খুলে নরম শরীরটাকে পেতে ধরতে হয় সাগর তলায়- হাঁটাচলাও করতে হয় অতি মন্থরভাবে। সাগর তলায় বালুকণার অভাব নেই। চলতে গেলে অনেকসময় ছােট বালুকণা ঢুকে পড়ে শরীরের ভেতরে। তখন খুব অস্বস্তি অনুভব করে। থলথলে শরীর বলে কিছুতেই বেরিয়ে যেতে পারে না- একেবারে লেপটে থাকে যেন। তখন অন্য উপায়ে অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে। খােলকের তলায়, দুদিকের দুটি ঝিল্লী থেকে লালা ঝরতে শুরু করে এবং সেই লালা বালুকণাটিতে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে ফেলে।


লালার নিঃসরণ ঘটে অনেকদিন পর্যন্ত। পর পর সেই লালা শক্ত হয়ে ওঠে। আন্তরণের পর আস্তরণ জমা হয় পেঁয়াজের খােসার মত। কালক্রমে আন্তরণগুলাে শক্ত হয়ে ওঠে এবং ঐটি শেষ পর্যন্ত মুক্তোর রূপ নেয়।


বর্তমানে প্রাকৃতিক মুক্তা খুব বেশী পাওয়া যায় না। ওকে সংগ্রহ করে ডুবুরীরা। মুক্তোর দামের জন্য কৃত্রিমভাবে চাষ করা হচ্ছে আজকাল। ফরাসী বিজ্ঞানী লিনের গবেষণাকে অবলম্বন করে বড় বড় চৌবাচ্চায় পার্লঅয়েস্টারদের পালন করা হয়। অতি দক্ষতার সঙ্গে এবং অত্যন্ত সাবধানতায় ঝিনুকের শরীরে ছােট্ট বালুকণা কৃত্রিমভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কখনও বা স্বল্প একটু আঁচড় কেটে দেহে অস্বস্তির সৃষ্টি করা হয়। লক্ষ্য করা হয়, অস্বস্তিটা যেন ওকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে না যায়। অনেক শিক্ষিত ডুবুরীও ওদের উপনিবেশে গিয়ে বালুকণা প্রবেশ করিয়ে আসেন।


ঝিনুকদের দেহে মুক্তো জমতে দীর্ঘ সময় লাগে। কৃত্রিম উপায়ে মুক্তো তৈরি করতে গেলে এতদিন অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। মাত্র কয়েক বছরের ভেতরেই ঝিনুকের দেহ থেকে মুক্তোটা বার করে আনা হয়। এই মুক্তো স্বাভাবিক মুক্তো অপেক্ষা ছােট্ট এবং নিকৃষ্ট। স্বাভাবিকভাবে ঝিনুকের দেহে যে মুক্তো জন্মে তা বেশ বড় হয় এবং রঙটা গােলাপী আভাযুক্ত আর কৃত্রিম মুক্তো সাদা। নানা দেশে মুক্তোর চাষ হচ্ছে আজকাল। জাপান এ বিষয়ে অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছে। সেখানকার মেয়েরে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারাই মুক্তো চাষের সঙ্গে বেশী যুক্ত থাকেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post