ডিনামাইট
এক ছিলেন রসায়নবিজ্ঞানী, নাম তাঁর হেনরী ব্লেকনন্ট। একদিন কী খেয়াল হল তাঁর। রসায়নাগারে এটা-ওটা মিশিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ চিনির সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিড মিশিয়ে ফেললেন। সেটি ছিল ইংরাজী ১৮৩২ সাল। ব্রেকনন্ট আপন অজান্তেই প্রথম জন্মদান করলেন একটি বিস্ফোরক পদার্থকে।
কথাটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অপরাপর বিজ্ঞানীরাও বিস্ফোরক পদার্থের সন্ধান করতে লাগলেন। হেনরী ব্রকনন্টের আবিষ্কারের বছর ছ-সাত পারে ডুমাস' এবং পেলিউস' নামে দুজন বিজ্ঞানী আর একটি বিস্ফোরক তৈরি করে ফেললেন। তাঁরা তৈরি করছিলেন তুলা এবং কাগজের সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিড মিশিয়ে। এবারের বিস্ফোরকটিও পূর্বের অনুরূপ ছিল।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তাঁরা চাইলেন আরও তীব্র বিস্ফোরক পথ তৈরি করতে। সে আশাও পূর্ণ হল। ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে আস্থানি ৩ সােৱেৱৱা' নামে দুজন বিজ্ঞানী বিস্ফোরক পদার্থের খোঁজ করতে গিয়ে দৈবক্রমে একদিন মিশিয়ে ফেললেন চিনি ও গ্লিসারিনের সঙ্গে নাইটিক অ্যাসিড। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে ঘটল জোর বিস্ফোরণ। চমকে উঠলেন তাঁরা। এই বিস্ফোরণ পূর্বের সমস্ত বিস্ফোরণের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেল।
সারিন এবং নাইট্রিক অ্যাসিড থেকে জন্ম নিল বলে বিস্ফোরকটির নাম হল নাইটোরিসারিন। প্রকৃতপক্ষে সেইদিনই ভয়াবহ বিস্ফোরককে করায়ত্ত করল মানুষ। নাইট্রোগ্লিসারিন এমন জিনিস-যাকে সামান্য একটা আঘাত করলেই বিক্ষোরণ সহকারে জুলে উঠে।
দেশে দেশে সাড়া পড়ে গেল। শত শত বিজ্ঞানী কাজ আরম্ভ করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনকে নিয়ে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যেন প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে গেল। কে কতভাবে ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়ােগ করতে পারে নাইট্রোগ্লিসারিনকে ! এই কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীকে হারাতে হল প্রাণ, কত জনে হয়ে গেলেন পঙ্গু, তবুও তাঁরা পেছু হটলেন না। সৃষ্টির নেশায় সাক্ষাৎ মৃত্যুকেও পরোয়া করলেন না বিজ্ঞানীরা।
এবার এগিয়ে এলেন সুইজারল্যান্ডের সুপ্রসিদ্ধ রসায়নবিজ্ঞানী আলফ্রেড বার্নাড নােবেল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, নাইট্রাগ্নিসারিনকে নিরাপদে ব্যবহার করা। দীর্ঘদিন ধরে উপায় খুঁজছিলেন তিনি। শেষে তাঁর সাধনা বাস্তবে রূপায়িত হল। আবিষ্কৃত হ'ল ডিনামাইট।
পরীক্ষা করতে করতে একদিন টের পেলেন নােবেল "কাইজেলগার" নামে এক রকমের সচ্ছিদ্র মাটি নাইট্রোগ্লিসারিনকে শােষণ করতে পারে। নােবেল তাখন কাইজেলগার দিয়ে নাইট্রোগ্লিসারিনকে শােষণ করালেন। সামান্য আঘাতে নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরণ ঘটানাের ক্ষমতা হারাল। তারপর স্যার নােবেল নাইট্রোগ্লিসারিন যুক্ত কাইজেলগার দিয়ে তৈরি করলেন এক বিস্ফোরক। এর মধ্যে নাইট্রোগ্লিসারিনের ক্ষমতা পুরােপুরি অটুট থাকল অথচ ওকে নিরাপদে ব্যবহারও করা গেল। এইভাবে উৎপন্ন হল সে যুগের সবচেয়ে বিস্ফোরক ডিনামাইট। কাইজেলগার শােষিত নাইট্রোগ্লিসারিন দ্বারা নির্মিত ডিনামাইটের নাম দিলেন নােবেল "গার ডিনামাইট"।
নােবেল কিন্তু গার ডিনামাইট প্রস্তুত করে ক্ষান্ত হলেন না। নাইট্রোগ্লিসারিনকে আরও নিরাপদে ব্যবহার করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাই করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, ভাল শােষক হলেই নাইট্রোগ্নিসারিনের নিরাপত্তা বেড়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভাল শােষক খুঁজতে।
তাঁর খোঁজাখুঁজি ব্যর্থ হলনা। একদিন হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে গেলেন সােরাকে। দেখলেন তিনি, কাইজেলগারের চেয়ে সেরা উত্তম শােষক। তারউপর সােরা উত্তম জারকও বটে। সােরাতে থাকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন। বিস্ফোরণ ঘটলে তার সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে বিস্ফোরণের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়।
নােবেল এবার তৈরি করতে লাগলেন নানা ধরণের ডিনামাইট। নাইট্রোগ্লিসারিনের পরিমাণ বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন এবং নিম্ন শক্তিসম্পন্ন উভয় প্রকার ডিনামাইট তৈরি হল মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য।
নােবেলের পরীক্ষা কিন্তু এইখানে থেমে গেল না। একদিন প্রস্তুত করলেন অ্যামােনিয়া ডিনামাইট। এই ডিনামাইটের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এর আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে না। অপরাপর ডিনামাইট অপেক্ষা অ্যামােনিয়া ডিনামাইট হল অনেক বেশি নিরাপদ।
