অণুবীক্ষণ যন্ত্র ( Microscope) কি কেনো কিভাবে আবিষ্কার হলো।

 অণুবীক্ষণ যন্ত্র।


তিনশ' বছরেরও বেশী সময় আগে হল্যান্ডের ডেলফট শহরে বাস করতেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলােক । নাম তাঁর লিউয়েনহােয়েক। চশমার দোকানে বসে কাচকে ঘষে ঘষে নানা ধরণের লেন্স বানাতেন এবং তামার পাতের তৈরি নলের তলায় লেন্সকে পরিয়ে এটা ওটা পরীক্ষা করতেন। আর এতে মাঝে মাঝে এমন ব্যস্ত হয়ে উঠতেন যে, খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলতে সময়ও পেতেন না। কখনও কখনও বিরক্ত হয়ে খদ্দেরদের তাড়িয়েও দিতেন। তা সত্ত্বেও খদ্দেররা আসতেন ওঁর তৈরি চশমার গুণের জন্যই। অনেকে অবশ্য বুড়াে মানুষের ছেলেখেলা দেখতেও আসতেন, আড়ালে আবডালে বিদ্রুপ করতেন, আর ভাবতেন ভদ্রলােকের মাথায় স্কুটা একটু ঢিলে আছে।



যাই আপন হাতে তৈরি সেই অণুবীক্ষণযুন্ত্র লিউয়েনহােয়েকের পাগলামােকে আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানের কাজকর্ম একেবারে পরিত্যাগ করে মেতে উঠেছিলেন প্রাণীর চামড়া, লােম,পানি প্রভৃতি বস্তুকে নিয়ে। একদিন কী খেয়াল হলাে তাঁর। কোথেকে সংগ্রহ করে আনলেন কয়েকফোটা পচা পানিকে। আর ঐ পচা পানির একফোটা একটা কাচের ফলকের উপর রেখে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করলেন।


এবার কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন লিউয়েনহােয়েক। দেখলেন, পানির মধ্যে কিলবিল করছে অসংখ্য ক্ষুদ্র জীব। এবার পরিষ্কার পানি নিয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করলেন। দেখতে পেলেন, এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবের সংখ্যা নিতান্ত কম।

লিউয়েনহােয়েক এইখানে থেমে গেলেন না। পরিষকার স্বচ্ছ পানি টবে করে





কিছুদিন খােলা জায়গায় বসিয়ে রাখার পর তাঁর সেই যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করলেন। এবারে দেখলেন, পূর্বের দূষিত পানির মত প্রচুর জীবের সমাবেশ ঘটেছে। সেদিন তাঁর ধারণা হয়েছিল, পানিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব বাস করে। ওরা এত ক্ষুদ্র যে, খালি চোখে দেখা যায় না। পচা পানিতে ওরা সংখ্যায় বেশী থাকে এবং এরা আপনা হতেই জন্মায়। লিউয়নহােয়েক তাঁর পরীক্ষার ফলাফল একদিন রয়েল সােসাইটিতে লিখে পাঠালেন। সােসাইটির সদস্যরা প্রথমে পাগলের পাগলামি ভেবে হেসে উড়িয়ে


দিয়েছিলেন। সেদিন বিজ্ঞানীদের সম্পূর্ণ অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিল


লিউয়েনহােয়েকের কথাগুলাে। সবার মনেই প্রশ্ন এসেছিল, একফোঁটা পানিতে কী হাজার হাজার জীব বাস করতে পারে? জীব ঋ এত কু্র হতে পাবে যা চোখে দেখা যায় না? যে যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায় যে টাই লা কোন হতে পারে?


কয়েকজন বিজ্ঞানী অবশ্য স্থির করলেন, পাগল লিউয়েনহোয়েকের পাগলামিটা একবার অক্ষ করা যাক। লোক যখন বলেছেন, 'থেৰ গাঞ্জাখাে সবাইকে দেখাবেন, তখন সময় করে একদিন তার গানে যেতে আপত্তি কোথায়।


সেদিনও লিউয়েনহােয়েক তাঁর যন্ত্রের সাহায্যে পানি ও অন্যান্য জিনিসকে পরীক্ষা করছিলেন। ঠিক সেই সময় বিজ্ঞানীরা সদলবলে হাজির হলেন তার দোকানে। বললেন-“আমরা সবাই রয়েল সােসাইটি থেকে আসছি। আপনি কীসব অদ্ভুত পরীক্ষার কথা লিখেছিলেন, সেগুলি দয়া করে আমাদের সামনে করে দেখালে খুবই আনন্দিত হবাে।


হাসলেন লিউয়েনহােয়েক। তারপর একে একে সমস্ত পরীক্ষাই করলেন বিজ্ঞানীদের সামনে। এবার বিজ্ঞানীদের অবাক হওয়ার পালা। পানিতে যে এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব বাস করতে পারে-এ শুধু তাঁদের নয়, পৃথিবীর সব মানুষেরই কল্পনার বাহিরে ছিল। না দেখলে কোনদিনই বিশ্বাস করতে পারতেন না তাঁরা।


বিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে ফিরে এলেন রয়েল সোসাইটিতে। সঙ্গে করে আনলেন লিউয়েনহােয়েকের একটি যন্ত্র এবং কিছু দূষিত পানি। তাঁরা সবাই মিলে আরও নানাধরণের পরীক্ষা চালালেন। শেষে প্রচার করলেন লিউয়েনহােয়েকের সেই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের কথা এবং তখনই দেশময় একটা সাড়া পড়ে গেল।


লিউয়েনহােয়েকের সেই চশমার দোকান এবার যেন তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হলাে। দলে দলে মানুষ ছুটে এলাে দোকানে এবং পরীক্ষাগুলি দেখে বিশ্বয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কথিত আছে, স্বয়ং রাজা ও রাণী উভয়ে একদিন এসেছিলেন লিউয়েনহােয়েকের দোকানে-পানিতে বসবাসকারী অত্যাশ্চর্য জীবগুলােকে দেখার জন্য। শােনা যায়, রাশিয়ার জারও এসেছিলেন একদিন।



লিউয়েনহােয়েকের পরীক্ষা কিন্তু ঐখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি তাঁর যন্ত্রের সাহায্যে ধরতে পেরেছিলেন মানুষের মুখে, দাঁতে এবং খাদ্য নালীতেও অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব বাস করে। আর এও বুঝেছিলেন, সেই জীবাণুদের অনেকে যেমন ক্ষতি করে, তেমনই উপকারও কেউ কেউ।


লিউয়েনহায়েক মাঝে মাঝে পাগলামাে যে করেন না এমন নয়। আনেক নয় করতেন কী? নিজের মুখকে জীবাণুনা করতে কখনও কখনও মুখে পরম কফি চেলে দিতেন এবং কষ্টও ভােগ করতেন।


সত্য কথা বলতে কী, জীবাণু সম্বন্ধে প্রকৃত গবেষণা প্রথমে পাগল দিনহেয়েই শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর সেই পাগলামি যে বিশ্বের বিয়নকে এতখানি সমৃদ্ধ করবে- সেদিন সেই স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু আজ! সবাই একবাকো স্বীকার করেন, বিজ্ঞানে লিউয়েনহােয়েকের অবদানের কোন কুলনা নেই।


Post a Comment

Previous Post Next Post