প্লাস্টিক সার্জারী
আইভারসন নামে এক ডাক্তার হাসপাতালে রােগীদের দেহে অস্ত্রোপচার করতেন। হাতটি খুব ভাল হওয়ার নাম করা এক শল্যচিকিৎসকরূপে পরিচিত হয়েছিলেন দেশ বিদেশের বহু রােগী আসতাে তাঁর কাছে অস্ত্রোপচারের জন্য। একবার আইভারসনের কাছে এল এক তরুণী। গুটি বসন্ত হয়েছিল তার। প্রাণে বেঁচে গেলেও মুখের শ্রীটা হারিয়েছিল চিরতরে। অর্থাৎ সারা মুখটা বসন্তের দাগে এমনভাবে ভরে গিয়েছিল যে, দেখলে তাকে ভয়ই করতাে মানুষের।
তরুণীটি খুব কাঁদাকাটা করে বললাে-“আপনি ডাক্তার, দয়া করে আমার মুখশ্ৰীটাকে ফিরিয়ে দিন! আমি যেআর লােক সমাজে মুখ দেখাতে পারছিনা!”
ডাক্তারের ছিল বড় দয়ার শরীর। মেয়েটির মনের ব্যথা তাঁর মনকে ক্ষতবিক্ষত করলাে। কিন্তু করবেন কী! এমন উপায় তাে জানা নেই তার! তবু সরাসরি মেয়েটিকে 'না' বলতে পারলেন না ডাক্তার। বললেন “তুমি আজ এসাে, কথা দিলাম, তােমার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবােই।”
এতবড় এক ডাক্তারের কথা কী মিথ্যে হতে পারে! চোখ মুছে বেশ খুশি মনেই মেয়েটি বিদায় গ্রহণ করলাে । কিন্তু ডাক্তার! মহাচিন্তায় পড়লেন তিনি।
কেমন করে মেয়েটির মুখ থেকে বসন্তের দাগকে পরিষ্কার করবেন তিনি। রাতদিন কেবলই ভাবেন ডাক্তার। কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারেন না। শুধু সেই তরুণীটির কুৎসিত ও করুণ মুখখানি তাঁর মনকে ক্ষতবিক্ষত করে।
বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন ডাক্তার। মেয়েটি এলে কী করে সাম্ত্রনা দেবেন তাঁকে।
ডাক্তার এবার যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। সকালে, সন্ধ্যায়, একা একা পথে পথে ঘুরে বেড়ান আর ভাবেন। একদিন এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি দেখলেন, পথের পাশে এক রেড ইন্ডিয়ান যুবক আগ্রহী পথচারীদের হাতে উদ্ভ কাটাচ্ছে। কী ভেবে ডাক্তার যুবকটির উল্কি কাটানাে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন সেখানে।
একজনের হাতে উক্তি কাটানাে শেষ করে যুবকটি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে-“উক্তি কাটাবেন স্যার!”
মৃদু হাসলেন ডাক্তার। যুবকটি পুনরায় বললাে-“আমি খুব ভাল উক্তি কাটিয়ে দেবাে স্যার ! আর যদি পছন্দ না হয়, তাহলে সে উক্তি তুলেও দেবাে। কুঞ্চিত করলেন ডাক্তার। বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন-“উন্ধিকে তুলে দেওয়া যায় নাকি!”
যায় বৈকি!’ মৃদু হেসে জবাব দিল যুবকটি। ডাক্তার কৌতুহলী হয়ে কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন-"আমার দুহাতে উল্কি কাটিয়ে দাও। কিন্তু একটা হাতের উকি তােমাকে তুলে দিতে হবে।" যুবকটি অতি অল্প সময়ের ভেতরে ডাক্তারের দুটো হাতেই উক্তি কাটিয়ে দিল। তারপর একটি হাতের উদ্ভিকে উঠিয়ে ফেলার পালা। যুবকটি এবার করলাে কী! উদ্কি তুলতে গিয়ে ডাক্তারের হাতে জোরে পাথর ঘষতে শুরু করলাে। ডাক্তার যন্ত্রণায় ব্রিত বােধ করলেন, তবু বাধা দিলেন না, বা মুখটাকেও একটু বিকৃত করলেন না। পরম আগ্রহভরে শুধু প্রত্যক্ষ করে গেলেন যুবকটির কাজের ধারা।
উল্কির দাগ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর যুবকটি ডাক্তারের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। বললাে- "কয়েকটা দিন পরে খুলে দেখবেন স্যার, উল্কির দাগতাে থাকবেই না অধিকন্তু ক্ষতের দাগটাও মিলিয়ে যাবে।”
রেড ইন্ডিয়ান যুবকটির কথামত কয়েকদিন পরে ব্যান্ডেজ খুলতেই ডাক্তার অবাক হয়ে গেলেন। উল্কির দাগ আদৌ নেই এবং ক্ষতস্থানটাও একেবারে পরিষ্কার। কে বলবে, কয়েকটা দিন আগে পাথর ঘষে ঘষে জায়গাটার চামড়া একেবারে তুলে ফেলা হয়েছিল।
এবার যন্ত্রপাতি নিয়ে ডাক্তার গবেষণায় বসে গেলেন। অচিরেই আবিষ্কার করলেন, আমাদের গায়ের ঐ চামড়াটারও কয়েকটা স্তর আছে। যদি কোন ক্ষত চামড়ার দ্বিতীয় স্তর অবধি বিস্তৃত হয়, তাহলে তাকে পরিষ্কার করে দিলেই স্বাভাবিকভাবে নতুন চামড়া গজায় এবং চামড়াকে মসৃণ করে দেয়।
ডাক্তার তার এই নতুন অভিজ্ঞতা প্রথম প্রয়ােগ করলেন বসন্তের দাগেভরা সেই তরুণীটির মুখের উপর। রেড ইন্ডিয়ান যুবকটির মত হাতুড়ে পদ্ধতি অবলম্বন করলেন না। দস্তুরমত মেয়েটিকে অজ্ঞান করিয়ে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অস্ত্রোপচার করলেন। তারপর মুখটাকে ব্যান্ডেজ করে রাখলেন সেই হাসপাতালে-নিজের তত্ত্বাবধানে।
নির্দিষ্ট দিনে ডাক্তার দুরু দুরু বুকে নিজেই ব্যান্ডেজ খুললেন মেয়েটির। এবার যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না ডাক্তার। কোথায় সেই কুৎসিত মুখ, আর কোথায়ই বা সেই কালাে কালাে বসন্তের দাগ! তার জায়গায় এক চমৎকার লাবণ্যমন্ডিত মুখ!
মেয়েটি খুশি হয়ে চলে গেল। আর সেই থেকেই পাশ্চাত্যে প্রথম প্লাস্টিক সার্জারীর সূত্রপাত। আজকাল এই পদ্ধতির আবার অবিশ্বাস্যভাবে উন্নতি হয়েছে। উক্ত পদ্ধতির সাহায্যে কেবল পঙ্গু ও বিকলাঙ্গদের দেহসৌষ্ঠবকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না, অকেজো চোখ, হৃৎপিন্ড, কিডনী প্রভৃতিকেও প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে।
