এক চিত্রকর
রাতদিন ঘরের কোণে বসে থাকতেন আর আপন মনে একের পর এক কেবল ছবি আঁকতেন।
একবার কী
খেয়ালে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দেশভ্রমণে। উদ্দেশ্য, বিভিন্ন
জায়গায় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করা, নানা দেশের জনজীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া
এবং সেরা সেরা চিত্রশালাগুলি পরিদর্শন করা। এক বছর কেটে গেল বৎসরান্তে লন্ডন থেকে
জাহাজে বাড়ী ফিরছেন, জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক চিত্রকর রােজই
দেখতেন, ভদ্রলোক সামনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি পেতে দিয়ে কী সব করেন আর
তন্ময় হয়ে ভাবেন।
চিত্রকর কৌতুহল দমন করতে না পেরে একদিন গায়ে পড়ে আলাপ করলেন
ভদ্রলােকটির সঙ্গে। ভদ্রলােকের বাড়ী ফ্রান্সে। নাম জ্যাকসন। পেশায় ডাক্তার হলেও
ডাক্তারী করা ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগে। এখন বিদ্যুৎকে নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠেছেন।
অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি দেখে চিত্রকর বায়না ধরলেন, কয়েকটা পরীক্ষা তাঁকে দেখাতেই
হবে ।
এমন আগ্রহী দর্শক বােধ হয় আগে কখনাে লাভ করেননি জ্যাকসন। তাই বিদ্যুৎ
সম্বন্ধে বক্তৃতা ও পরীক্ষা দুইই চললাে। একসময় লােহার তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎকে
পাঠিয়ে জ্যাকসন দেখালেন, লােহার তারটা সঙ্গে সঙ্গেই চুম্বকে পরিণত হয়ে গেল।
কিন্তু প্রবাহ বন্ধ করার সাথে সাথে চুম্বকের গুণ একটুও অবশিষ্ট রইল না।
চিত্রকর
বিস্ময়ে অভিভূত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, লােহার তারটা যদি খুব খুব বড় হতাে তাহলে
কী হতাে?
জ্যাকসন হেসে বললেন, তার যত লম্বা হােকনা কেন বিদ্যুতের দ্বারা
পরিব্যাপ্ত হতে খুব একটা দেরী হতাে না।
চিত্রকরের ভাবপ্রবণতা বেড়ে গেল। উদাস
দৃষ্টিতে জ্যাকসনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন 'লম্বা তারের এ প্রান্ত থেকে ও
প্রান্ত পর্যন্ত যদি বিদ্যুৎ কি পাঠানো যায়, মুখের কথাকে বা কোন শব্দকে কেন
পাঠানাে যায় না?
জ্যাকসন গম্ভীর হলেন। বললেন, কেন পাঠানাে যাবে না? আপনি নিজেই
একবার চেষ্টা করে দেখুন না কেন? কথাটা খুব মনে ধরলাে চিত্রকরের । বাড়ী এসে ঘর
ভরিয়ে ফেললেন লোহার তার, তামার তার, স্কু, পেরেক, চুম্বক, হাতুড়ির, ব্যাটারি
প্রভৃতি দিয়ে । অষ্টপ্রহর কেবল ঠুকঠাক আর খুটখাট । সবাই ভেবে নিল, চিত্রকরের
মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। এদিকে জিনিসপত্র কিনতে কিনতে চিত্রকর ফতুর হয়ে
গেলেন। হাতে। পয়সাকড়ি নেই, কিন্তু যন্ত্র না হলে গবেষণা চলবে কেমন করে? তখন
বাধ্য হয়ে। নিজের হাতেই যন্ত্রপাতি তৈরি করতে হলাে। চিত্রকরের সেই অতন্দ্র সাধনা
কিন্তু ব্যর্থ হলে না। একদিন আপন উদ্ভাবিত যন্ত্রের মাধ্যমে তারের ভিতর দিয়ে
সঙ্কেত প্রেরণে সমর্থ হলেন । সে সঙ্কেত খুব বেশী দূরে প্রেরণ করতে পারলেন না বলে
পুনরায় গবেষণা করতে হলাে। শেষে রিলে পদ্ধতি আবিস্কারের মাধ্যমে দূরকে নিকট করলেন।
শুরু হলাে বিজ্ঞানের। জয়যাত্রা। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর চিত্রকর তৎকালীন
মার্কিন সরকারের শরণাপন্ন। হলেন। অনুরােধ রাখলেন, আর্থিক আনুকুল্য লাভ করলে তিনি
বহু দূরবতা। জায়গায়ও নিমেষের মধ্যে খবর প্রেরণ করতে পারবেন। সরকার এই মহান
আবিস্কারকে স্বাগত জানালেন এবং প্রথম কিস্তিতে মঞ্জুর করলেন ত্রিশ হাজার ডলার। ঐ
অর্থে চিত্রকরটি তখন ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোর পর্যন্ত খবর পাঠানাের জন্য লাইন
টেনে নিয়ে গেলেন। এইটিই পৃথিবীর প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন। খবরের সংকেত প্রথম প্রেরণ
করেছেন চিত্রকর নিজেই। সংকেত ছিল। “ঈশ্বরের অনুগ্রহে সম্ভব হলে।” নিমেষের মধ্যে
সংকেত টি ওয়াশিংটন থেকে পৌঁছে গিয়েছিল বাল্টিমোরে। সেই প্রথম দূরত্ব কে বধ করল
মানুষ এবং চিত্রকর পরিচিত হলেন জগৎ পূজ্য বিজ্ঞানীরা ।। এই চিত্রকর আর কেউ নন,
টেলিগ্রাফের আবিষ্কর্তা স্যার স্যামুয়েল মাের্স ।
