সাইকেল ( Bike) আবিস্কারের কাহিনী



 প্রায় শ' তিনেক বছরের প্রচেষ্টায় সাইকেল লাভ করেছে তার প্রকৃত রূপ।। অনেকে মনে করেন, ইতালি রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত চিত্রকর ও প্রযুক্তিবিদ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সাইকেলের প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন।

 যতদূর জানা গেছে, তাতে মনে হয় সপ্তদশ শতাব্দির মধ্যভাগে এবং একেবারে শেষ দশকে জাঁ থীসন এবং দ্য সিভরাক নামে দুজন অবশ্য ঠিক ঠিক সাইকেল বলা যাবে না। কারণ, ওদের সামনে ও পেছনে দুটো চাকা থাকলেও চাকা দুটিকে একটি লম্বা কাঠের দন্ড দুই পাশে এমন দৃঢ়ভাবে আটকানো। হয়েছিল যে, চাকাগুলো ভালো ভাবে ঘুরতে পারে। দণ্ডের মাঝখানে ছেড়া নেকড়ার ফালিকে জড়িয়ে “সিটের ব্যবস্থা করেছিলেন ভদ্রলােক। হাতল, ব্রেক, প্যাডেল ইত্যাদি কিছুই ছিল না। শুধু হাতলের বদলে ছিল একটা লম্বাটে ধরণের কাঠের ফালি। ঐ কাঠের ফালিকে ধরে মাটিতে পা ঠেকিয়ে তিনি মাঝে মাঝে সামনে ঠেলা দিতেন। তাতে চাকা দুটো ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা পথ এগিয়ে। যেতাে। শােনা যায়, সেই সিভরাক নিজের তৈরি ঐ সাইকেল ছাড়া এক পাও হাটতেন না।


দ্য সি বরাকের দেখা দেখি অনেকেই সাইকেল তৈরি শুরু করেন। বলা। বাহুল্য, সে সব সাইকেল.সিভরাকের অনুকরণ ছাড়া কিছুই ছিল না। পরবর্তী। প্রায় একশ বছর কাল ওর তেমন জনপ্রিয়তাও ছিল না। তবে ওর উন্নতির প্রতি অনেক যত্নবান হয়েছিলেন এবং কিছুটা নতুনত্ব নিয়েছিলেন কাল ভাইজান নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক ও ব্যারন ভন ড্রাইস নামে জনৈক জার্মান। গতিবেগ বাড়ানাের জন্য ওঁরা নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছিলেন। কেউ দুটো সমান আকারের চাকা, কেউ বা সামনে বড় এবং পেছনে ছােট চাকা যুক্ত করেছিলেন ইত্যাদি। হাতলের কিছুটা উন্নতি হলেও চালাতে হতাে মাটিতে পা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে। 

উনবিংশ শতাব্দীতে সাইকেলের বিবর্তন শুরু হয় দ্রুতগতিতে । আত্মপ্রকাশ। করতে থাকে একে একে নতুন ধরণের সাইকেল । নির্মাতাদের মধ্যে ব্যারন দ্য গ্যাভারবর্নের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনি সাইকেল এর প্রকৃত হাতল যুক্ত করেন এবং গতিবেগ বাড়ানাের জন্য চাকার তলায় লােহার পাত পরিয়ে দেন। ' 

গ্যাভারবর্নের সাইকেল যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাই তাকে খুলতে হয়েছিল সাইকেল তৈরির কারখানা। এই সাইকেলের নাম ছিল ডান্ডি হর্স বা বাবুঘােড়া। সমগ্র ফ্রান্স ও ইংলন্ড ডান্ডি হর্সে ভরে গিয়েছিল। তবে এতেও প্যাডেল ছিল না, সেই মাটিতে পা ঠেকিয়ে ঠেলা দিতে হতাে। 

আধুনিক সাইকেল প্রথম রূপকার স্কটল্যান্ডের প্যাট্রিক ম্যাকমিলান। ইনিই প্রথম সাইকেলে প্যাডেল যুক্ত করেন এবং সেই থেকে সাইকেল চালানোর প্রধান অসুবিধা দূরীভূত হয়। তবে। ম্যাকমিলান সাহেবের সাইকেলের দুটি চাকা সমান ছিল না। সামনের চাকা অপেক্ষা পেছনের চাকাটি ছিল খুবই ছােট।

                                     ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে ম্যাকমিলানের তৈরী প্যাডেল যুক্ত বাইসাইকেল 

                                            ম্যাকমিলান তৈরি প্রথম দুই চাকার বাইসাইকেল ।

 গ্যাভারবর্নের পর প্যাডেল ও চাকাকে নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু হয় গবেষণা। আত্মপ্রকাশ করে “বর্ণ শেখার”, “কভেন্ট্রি ট্রাই সাইকেল,” “রোভার” প্রভৃতি নানা ধরণের সাইকেল । পরিশেষে বহু জনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়, সাইকেলের দুটো চাকা সমান হলে সুবিধা বেশী পাওয়া যায় এবং নিরাপদও।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত সাইকেলের চাকার তলায় টায়ার টিউব কিন্তু পরানো হতো না। তবে হাতে, সিট, প্যাডেল প্রভৃতি উন্নতি হয়েছিল অনেকখানি। সাইকেলের চাকার তলায় রবারের টিউব পরিয়ে গতিবেগ। বাড়িয়েছেন ডানলপ সাহেবের সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ডানলপ সাহেব ছিলেন আয়ারল্যান্ড লেখক এবং পেশায় ছিলেন ঘোড়ার ডাক্তার। তাঁর ছেলে জনি দূরের একটা স্কুলে পড়তে যেতাে বলে ডানলপ সাহেব তাঁকে কিনে। দিয়েছিলেন একটি সাইকেল। 

জনি ভালো সাইকেল চালাতে পারে। একবার স্কুলে সাইকেল রেস' নাম। দিয়ে বাবাকে এসে বলল-“বাবা, আমার সাইকেলটা বড্ড বেশি ঝাঁকুনি লাগে। আমাকে নতুন একটা সাইকেল কিনে দাও। আমি সাইকেল রেসে যােগ দিয়েছি।”

ডানলপ সাহেবের ছেলের কথা শুনে খুব করে ভাবলেন। একসময় তার মনে হল, নতুন সাইকেল কিনলেও ঝাকুনি লাগবে। তার চেয়ে ঝাকুনি না লাগার ব্যবস্থা কী করা যায় না। | ডানলপ সাহেব নতুন সাইকেল আর কিনলেন না। বুদ্ধি করে রেসের। আগের দিন জনির সেই পুরনো সাইকেলের চাকার তলায় বাগানে পানি দেওয়ার যে রবারের পাইপটি ছিল, তা থেকে দুটো টুকরা কেটে এনে আচ্ছা করে বেঁধে দিলেন।

জনি সাইকেলে চেপে দেখলে, সত্যি ঝাঁকুনি আর লাগেনা । গতি বেড়েছে অনেকখানি। সে খুশি হয়ে যোগদান করলে রেসে ।

বলা বাহুল্য রেসে প্রথম হয়েছিল জনি। অপরাপর সাইকেলকে অনেক পেছনে পড়ে থাকতে হয়েছিল। আর সাইকেল যে এত বেগে ছুটতে পারে - তা দেখে দর্শকরা ও বিস্মিত হয়েছিল ।

 এবার ডানলপ সাহেবের মাথায় ব্যবসার চিন্তা আসে। তিনি নিকটস্থ এক সাইকেল তৈরী কারখানার অংশীদার হয়ে চাকার তলায় টায়ার ও টিউব পরাতে শুরু করলেন। আর তখনই ডানলপ সাহেবের সাইকেলের একেবারে জয় জয়কার পড়ে গেল। বেশ কিছুকাল ধরে একচেটিয়া ব্যবসা করে নিলেন তিনি। 

এরপর থেকে সর্বত্রই শুরু হয়ে গেল চাকার তলায় টায়ার টিউব পরানাে। মাটির ঘর্ষণ কে উপেক্ষা করতে জুড়ি নেই বলে মোটর গাড়ির চাকার তলায়ও টায়ার টিউবের ব্যবস্থা। আর ঐ টায়ার টিউবের ক্ষেত্রে একমাত্র ডানলপ। কোম্পানীই সেদিন বিশ্বের সেরা বলে বিবেচিত হয়েছিল এবং এখনও সে সুনাম অক্ষুন্ন আছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post