অ্যালুমিনিয়াম
অনেক আগে ইতালির আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে রঙ-বেরঙের ভারি চমৎকার এক ধরণের পাথর কুড়িয়ে পাওয়া যেতাে। প্রাচীনকালে রােমানরা ঐ পাথরগুলােকে বলতেন অ্যালুমেন। আর ওকে তাঁরা ব্যবহার করতেন কোন কিছুকে রাঙাতে এবং ওষুধরূপে। যে কোন ধাতব পাত্রের গায়ে ওর প্রলেপ দিলে ঝকুঝকে ও সুন্দর দেখাতাে বলে অনেকেই অ্যালুমেনের খোঁজ করতেন। কিন্তু জিনিসটি যে প্রকৃতপক্ষে কী তার খবর কেউ রাখতেন না, বা ওকে পরীক্ষা করার চেষ্টাও কেউ করেননি।
অ্যালুমেনকে নিয়ে রােমানদের পরে কেউ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন কিনা বলা যায় না। তবে ব্যবহার ওর অব্যাহতই ছিল। আর ওকে প্রথম পরীক্ষা করার মনােভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন স্যার হামফ্রে ডেভি (১৭৭৮-১৮২৯ খ্রীঃ)। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন, অ্যালুমেন কোন মৌলিক পদার্থ নয়। এটির একটি উপাদান অক্সিজেন এবং অপর একটি উপাদান এমন একটি ধাতু-যার নাম আজও পর্যন্ত কেউ জানে না। অ্যালুমেনের অন্যতম উপাদান বলে ডেভি উক্ত ধাতুটির নামকরণ করেন “ অ্যামুমিনিয়াম”।
মজার কথা, ডেভি ধাতুটির নামকরণ করলেন বটে কিন্তু চোখে দেখলেন না। রীতিমত পরীক্ষাও চালালেন। তথাপি কোনমতেই অ্যালুমেন থেকে আসল ধাতুটির এক কণাও বিচ্ছিন্ন করতে পারলেন না।
ডেভির কাল কেটে গেল। অথচ নতুন ধাতুটিকে আবিষ্কার করার জন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা রইলাে অব্যাহত। ধীরে ধীরে যেন প্রতিযােগিতাও শুরু হয়ে গেল। কে আগে অ্যালুমিনিয়ামকে নিষ্কাশণ করতে পারে! শেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বহু সাধ্য সাধনার পর ওয়ের স্টেডর ও হরলার নামে দুজন বিজ্ঞানী অতি সামাণ্য পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন।
নতুন এই ধাতুটিকে দেখে বিস্মিত সবাই। কী চমৎকার রঙ, আর হালকা! যেন ক্ষুধিতের দৃষ্টি ফুটে উঠলাে সবার চোখে। প্রত্যেকেরই ধারণা হলাে, অ্যালুমিনিয়ামকে স্বল্প খরচে নিষ্কাশণ করতে পারলে সভ্যতার এক নতুন দিগন্তের উন্মােচন ঘটবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য । শত শত বিজ্ঞানীর সারা জীবনের সাধনা একেবারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে। অর্থাৎ কেউ পারলেন না অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশণের সহজতম পদ্ধতি আবিষ্কার করতে। সন্তুষ্ট থাকতে হলাে পূর্বের আবিষ্কারকদের আবিষ্কারকে নিয়ে-যাতে খরচ পড়তে সােনা এবং
প্লাটিনাম অপেক্ষাও বেশী।
আর এ কারণে ওর কৌলিন্যও সেকালে ছিল যথেষ্ট। কথিত আছে, একমাত্র। রাজরাজড়ারাই অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করতেন। যেমন ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়নের ভোজসভায় অতিথিরা ব্যবহার করতেন সােনার কাটা চামচ আর। তিনি নিজে ব্যবহার করতেন অ্যালুমিনিয়ামের।
এমনও শােনা যায়, প্রখ্যাত দিগ্বিজয়ী বীর নেপােলিয়ন বোনাপার্ট নতুন এই ধাতুটির প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বহু বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেছিলেন ধাতুটিকে সহজ উপায়ে নিষ্কাশণ করতে। মজবুত ও হালকা এই ধাতুটি দিয়ে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম বানাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু সে ইচ্ছে তাঁর অপূর্ণই থেকে গেছে।
বিজ্ঞানীরাও বুঝতে পেরেছিলেন ধাতুটির সম্ভাবনা প্রচুর। তাঁরা আরও আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীর এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে কত হরেক রকমের অ্যালুমিনিয়ামের আকরিক। এর প্রধান আকরিক বক্সাইট পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সুলভ। চুনি, পান্না, মরকতমণি, নীলকান্তমণি, বৈদুর্যমণি, গােমেদ প্রভৃতি মূল্যবান রত্ন-পাথরও অ্যালুমিনিয়ামের এক একটি আকরিক ছাড়া অন্য কিছু নয়।
কেন বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশ করতে?
বিজ্ঞানীরা ধাতু নিষ্কাশণের কতকগুলাে পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। যেমন, কোক কয়লার পরিবেশে পােড়ানাে, বিদ্যুৎ দ্বারা বিশ্লেষণ, ইত্যাদি। অ্যালুমিনিয়ামকে আবার অক্সাইডের আকারে পাওয়া যায়। অথচ অক্সাইড আকরিক তথা অ্যালুমিনাকে কয়লার সাহায্যে বিজারিত করলেই অ্যালুমিনিয়াম পাওয়ার কথা। কিন্তু এটি হালকা ধাতু বলে কয়লার সঙ্গে পােড়ালে অ্যালুমিনিয়াম বাষ্পকে পাওয়া যায়। সেই বাষ্পকে ঠান্ডা করলে মূল ধাতুর বদলে ফেরৎ পাওয়া যায় ঐ অ্যালুমিনাকেই।
ধাতু নিষ্কাশণের এক হাতিয়ার হলাে বিশুদ্ধ আকরিককে বিগলিত অবস্থায় অথবা ঘন দ্রবণকে বিদ্যুৎ দ্বারা বিশ্লিষ্ট করা। কিন্তু এ হাতিয়ারও ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্যুৎ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অ্যালুমিনিয়ামের পরিবর্তে অন্য পদার্থকে পেয়েছিলেন।
উপরােক্ত অসুবিধাগুলির জন্যই বিজ্ঞানীরা বাধ্য হয়ে একরকম হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু ওর বিরাট সম্ভাবনার কথা কেউ বিস্মৃত হতে পারেন নি।
তাই একদিন আমেরিকার ও বার্লিন কলেজে ধাতুবিদ্যা পড়াবার সময় একজন অধ্যাপক ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-“আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অ্যালুমিনিয়ামকে সন্তায় নিষ্কাশণ করা এখনও সম্ভব হলােনা। যদি স্বল্প খরচে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা যেতাে,তাহলে মানব সভ্যতার রূপটাই পরিবর্তিত হয়ে যেতাে।"
অধ্যাপকটি পুনরায় বলেছিলেন - “তােমাদের মধ্যে কেউ যদি অল্প খরচে পর্যাপ্ত অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশণের পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারাে, তাহলে একদিকে যেমন প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারবে, অপরদিকে তেমনই বিশ্বজোড়া সুনাম ও অর্জন করতে পারবে।"
ছাত্রদের ভেতরে ছিলেন কুড়ি বাইশ বছরের এক তরুণ। নাম তাঁর চার্লস মার্টিন হল। অধ্যাপকের উপদেশ তাঁরি মনের মধ্যে দারুণ এক প্রতিক্তিয়ার সতি করলাে এবং সেইদিন থেকেই শুরু তিনি করে দিলেন গবেষণা।
কতদিন কেটে গেল। বুঝিবা তাঁকেও শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়। কিন্তু অসীম তাঁর ধৈর্য, উৎসাহও তার অদম্য। বিগলিত অ্যালুমিনা বা তার ঘন দ্রবণকে তড়িৎ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে অ্যালুমিনিয়াম পাওয়া যায় না বলে দ্রবণের সঙ্গে নানা ধরণের পদার্থ মিশিয়ে বিদ্যুৎ চালাতে শুরু করলেন। গবেষণা করতে করতে একদিন সবিস্ময়ে দেখলেন মার্টিন হল ঋণাত্মক তড়িৎদ্বারে থরে থরে জমে উঠেছে ধধবে সাদা এক ধরণের ধাতু। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হলাে না তাঁর। এতদিন ধরে এত বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়ে শেষে তাঁরই হাতে কী ধরা দিল অ্যালুমিনিয়াম!
ধাতুটিকে বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করলেন। হ্যাঁ, অ্যালুমিনিয়ামই বটে। কিন্তু কী মিশিয়েছিলেন তিনি? শুরু হলে চিন্তাভাবনা। শেষে মনে পড়লাে, বিশুদ্ধ অ্যালুমিনার সঙ্গে ক্রায়ােলাইট ও ফ্লোরম পার নামক অন্য দুটি অ্যালুমিনিয়ামের আকরিককে মিশিয়ে ছিলেন। এবার বুঝতে পারলেন,অ্যালুমিনা সরাসরি বিদ্যুদ্বারা বিশ্লিষ্ট হয় না। ক্রায়ােলাইটকে মেশালে আগে ঐটিই বিয়ােজিত হয়ে অ্যালুমিনিয়াম উৎপন্ন করে। তারপর ক্রায়ােলাইটের মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ যত কমতে থাকে ততই সে অ্যালুমিনা থেকে অ্যালুমিনিয়ামকে অঙ্গীভূত করে নেয় এবং পুনরায় ক্রায়ােলাইটে রূপান্তিরিত হয়ে বিদ্যুৎ দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়। অর্থাৎ অ্যালুমিনা সােজাসুজি বিয়ােজিত না হয়ে ক্রায়ােলাইটের মাধ্যমে বিয়ােজিত হয়।
বিজ্ঞানীদের দীর্ঘকালের সাধনা এইভাবে চার্লস মার্টিন হলের হাতে সফল হয়েছিল। সেই অধ্যাপকের কথা মিথ্যে হয়নি। মার্টিন হল অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন এবং তাঁর এই অসামান্য অবদানের জন্য লাভ করেছিলেন নােবেল পুরস্কার। যদিও একই সময়ে হেঁরাে নামে জনৈক ফরাসী বিজ্ঞানী সেই একই পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর আবিষ্কার পরে প্রচারিত হয়েছিল বলে নােবেল পুরস্কার লাভ করতে পারেন নি। তবে অর্থ প্রচুর উপার্জন করেছিলেন।
