মুদ্রণযন্ত্র
এক ছিলেন মণিকার। অপরদিকে ভাল শিল্পীও ছিলেন তিনি। নানা ধরণের রত্নপাথরকে কেটে ভালভাবে পালিশ করতে পারতেন বলে নাম ডাক ছিল।
যথে। রাজ্যের যত ধনীব্যক্তি সবাই পছন্দ করতেন তাঁর কাজ। তাই বড় বড় লােকের মনােরঞ্জন করতে হতো বলে শিষ্ঠীকে একটু বেশী খাটতে হতাে। একদিন কাজ করতে করতে তারি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন শিল্পী। তাবলেন, আর আর ম। মনটাকে অবসাদমুক্ করার জন্য স্ত্রী এনাকে ডেকে বললেন
"এসো, এক হাত তাস খেলা যাক।" এনাও হাসিমুখে এগিয়ে এলেন তাস খেলতে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন তাস কিন্তু সহজলভ্য ছিল না। মােটা মােটা চারকোনা কাগজের উপর শিল্পীদের রঙ তুলির মাধ্যমে এক একটি করে ধৈর্যসহকারে ছবি আঁকতে হতাে। খেলা শেষে সেদিন শিল্পীর কী খেয়াল হলো! ভাবলেন, নিজের হাতেই ছবি একে এক বান্ডিল ভাল তাস তৈরি করে নেবেন।
শিল্পীর খেয়ালতাে! সঙ্গে সঙ্গে বসে গেলেন কাগজ ও রঙ-তুলি নিয়ে। কিন্তু কয়েকখানা আঁকার পর বিরক্ত হলেন মনে মনে । এতগুলাে তাসের ছবি আঁকা কম সময়ের ব্যাপার। শিল্পী তখন স্বল্প সময়ের মধ্যে কেমন করে বেশী তাস আঁকা যাবে-তারই চিন্তা শুরু করে দিলেন।
ঘরে হাতুড়ি বাটালি ছিল, আর ছিল টুকরাে টুকরাে কাঠ। শিল্পী ভেবে চিন্তে কয়েকখানা কাঠের টুকরে নিলেন এবং তাদের এক পাশে এক একটি তাসের ছবি খােদাই করলেন। তারপর কালি মাখিয়ে কাগজের উপর ছাপ দিলেন। চমৎকার চমৎকার তাস পাওয়া গেল। শিল্পী এবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাস হাতে ছুটলেন স্ত্রী এনার কাছে। এনাও খুব খুশি হলেন এবং উৎসাহিত করলেন আরও তাস তৈরির জন্য।
শিল্পীর আগ্রহ বেড়ে গেল। দোকানের কাজকর্ম আপাতত স্থগিত রেখে তাস তৈরির কাজে মন দিলেন। কয়েকদিনের ভেতরেই তৈরি করে ফেললেন কয়েক বান্ডিল তাস এবং বন্ধুদের এক এক বান্ডিল করে উপহারও দিলেন। অসুবিধাও অনুভব করলেন একটু। বুঝতে পারলেন, একটা কাঠের ছাঁচ দিয়ে কয়েকবার কাগজে ছাপ দিলে ছাপটা ভোঁতা হয়ে পড়ছে। ফলে আগের মত তত ভাল ছাপ পড়ছে না। অপরদিকে ছাঁচের উপর কালি বেশী-কম হলে, তাসের ছবিও খারাপ হয়ে পড়ে। উপরােক্ত অসুবিধাগুলিকে দূর করার জন্য অনেক খোজাখুজি করলেন। শেষে বুঝতে পারলেন, ছচ তৈরির কাজে একমাত্র আপেল গাছের কাঠই কিছুটা উপযােগী। অপরদিকে কালির বদলে কাজলের তেল ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায় বেশী।
শিল্পী এবার উন্নত মানের ছাঁচ এবং কালি তৈরী করে নিয়ে তাস ছাড়াও ছবি এবং অক্ষরকে কাঠের উপর থােদাই করতে শুরু করলেন। বড় বড় কাঠের ব্লকে মহাপুরুষের ছবি এবং ছবির নীচে সংক্ষিপ্ত জীবনী খােদাই করে কাগজের উপরছাপ দিলেন। চমৎকার ছবি পাওয়া গেল। ঐ ছবিকে দােকানেই খাটিয়ে রাখলেন। যাঁরা দেখলেন,তাঁৱাই অবাক হলেন। দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেনও অনেকে।
একদিন এক পাদরী সাহেব এলেন দোকানে। শিল্পীর নৈপুণ্য দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। ভাবলেন তিনি, যদি মহাজীবন কাহিনীগুলিকে এইভাবে ছেপে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করা যেতাে, তাহলে মানুষ অনেক উপকৃত হতাে!
পাদরী সাহেব ঘাট পৃষ্ঠার একখানা মহাজীবন কথার বই লিখে শিল্পীর কাছে এলেন। যেমন করে হােক ওকে ছাপাতেই হবে এবং প্রত্যেক মহাপুরুদের ছবিও দিতে হবে। শিল্পী প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেলেন। এতগুলাে অক্ষর কাঠে খােদাই করা কী চাট্টিখানি কথা। কিন্তু পাদরী সাহেব কিছুতেই ছাড়লেন না।
শেষে বাধ্য হতে হলাে শিল্পীকে। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন স্ত্রী এনা
এবং দু’জন অন্তরঙ্গ বন্ধু।
কয়েকমাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বইটির ছাপার কাজ সম্পূর্ণ হলাে। বই পেয়ে পাদরী সাহেব বেজায় খুশি হলেন। শিল্পীকে শুধু পারিশ্রমিক দিলেন না, উৎসাহিতও করলেন এবং বাইবেল ছাপতে অনুরােধ জানালেন।
শিল্পী কর্তৃক 'মহাজীবন কথার বইই পৃথিবীর প্রথম ছাপার অক্ষরের বই। ওতে কৃতকার্য হওয়ায় শিল্পী সত্য সত্যই একদিন বাইবেল ছাপতে মনস্থ করলেন। কাঠের উপর অনেক অক্ষরকে খােদাই করতে হবে। তাই স্ত্রী ও বন্ধুত্বয় ছাড়া আরও কয়েকজন সহযােগীর দরকার হলাে। আর্থিক অনটন সত্ত্বেও কেবলমাত্র মনের জোরকে সম্বল করে একদিন শুভক্ষণে এই মহানকর্মে ব্রতী হলেন।
চারদিনের দিন প্রস্তুত হলাে বাইবেলের প্রথম পৃষ্ঠার ব্লক। ব্লকখানাকে হাতে নিয়ে শিল্পী নিজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন ভাল করে। এমন সময় ঘটলাে এক অঘটন । ব্লকখানা হাত ফস্কে পড়ে গেল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে এক্কেবারে দু-টুকরাে।
এমন একটা মহান কাজে প্রথমে এই ধরণের একটা ধাক্কা গেয়ে শিল্পী একেবারে মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু এনা আদৌ ভেঙে পড়লেন না। তিনি উৎসাহিত করলেন স্বামীকে। বললেন-“এটিকে বাধা বলে মনে করছে কেন? ইশ্বরের ইচ্ছা বলে মনে করতে পারােনা! হয়ত তােমাকে দিয়ে তিনি আরও উন্নত কিছু করাতে চান! অতএব মন খারাপ না করে নতুন করে চিন্তা ভাবনা কর।”
এনার কথায় উৎসাহিত হলেন শিল্পী। কয়েকদিন ধরে খুব করে ভাবলেনও।
শেষে স্থির করলেন,কাঠের উপর অক্ষর খােদাই করতে গেলে যে কোন সময় এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তার চেয়ে কাঠের অক্ষর তৈরি করে কাঠের ফলকেএকটার পর একটা সাজিয়ে দিলে কেমন হয়। কোন কারণে ফলক যদি ভেঙ্গে যায়,কিংবা দু-চারটি অক্ষর নষ্ট হয় তাহলে অল্পায়াসেই ঠিক করে নেওয়া যাবে। শুধু কী তাই। অক্ষরগুলােকে সাজিয়ে বাইবেল ছাড়া অন্য বইকেও ছাপানাে যাবে।
বাইবেল ছাপার কাজ আপাতত স্থগিত রেখে অক্ষর তৈরির কাজে মন দিলেন শিল্পী। কয়েক মাস পরিশ্রম করে হাজার অক্ষর তৈরি হয়ে গেল শিল্পী এই অক্ষরগুলাের নামকরণ করলেন টাইপ।
পর্যাপ্ত অক্ষর হাতে আসায় শিল্পী এবার স্ত্রী এনা এবং সহযােগী বন্ধুদের নিয়ে বসে গেলেন কাঠের ফলকে সেগুলােকে সাজাতে। এবার খুব বেশী বেগ পেতে হলােনা। অতি অল্প দিনের ভেতরেই ছেপে ফেললেন পুরাে বাইবেল। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল এবং সেই থেকেই সূচনা হলাে মুদ্রণের কাজ।
এই খেয়ালি শিল্পীটির নাম গুটেনবার্গ। একদিন অপরিসীম ক্লান্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে তাতে তুলে নিয়েছিলেন তাস। আর সেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে গড়ে উঠলাে ছাপার কাজ! মানুষের কাছে এতদিনে উন্মুক্ত হলাে জ্ঞানের ভান্ডার।
শিল্পী গুটেনবার্গ সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন মুদ্রণশিল্পের উন্নতির জন্য। তিনিই উদ্ভাবন করে গেছেন কাঠের টাইপের বদলে ধাতুর তৈরী টেকসই টাইপ। তাঁকে সর্বোতােভাবে সাহায্যে করেছিলেন এনা।
শিল্পীর শেষজীবন বড় দুঃখময়। ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিলনা তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী এনার। কেবলমাত্র আবিষ্কারের নেশাটাই প্রবল ছিল। তাই পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে। এমনকি অর্থাভাবে সুচিকিৎসা না পেয়ে এনাকে অকালমৃত্যুও বরণ করতে হয়েছে।
এনার মৃত্যুর পর গুটেনবার্গ আর গবেষণা করতে পারেন নি। কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাঁকে কাল কাটাতে হয়েছিল। শেষে তাঁর সেই চরম অর্থসঙ্গটের দিনে মেঞ্জের পাদরী সাহেব নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে কিছু পেনসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
(অনেকের মতে খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভে চীন দেশে মুদ্রণ ব্যবস্থার প্রথম প্রচলন হয় এবং এর আবিষ্কারক বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ। জাপানী গাথায়ও লেখা আছে, ৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে দশলক্ষ মন্ত্র ছাপানাে হয়েছিল। চীনদেশে সে সময় কাগজের উপর বুদ্ধমূর্তির ছাপ দেওয়া হতাে বলেও প্রবাদ আছে। এগুলাের কিছু কিছু পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে রক্ষিতও আছে। তবুও ছাপাখানার প্রকৃত আবিষ্কর্তা বলতে শিল্পী গুটেনবার্গকেই ধরা হয়।)
